বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। জীবনের পরম সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন জননন্দিত সেই নেত্রী—বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
রাজনীতিকদের জীবনে উত্থান-পতন থাকে। মামলা–মোকদ্দমা, গ্রেপ্তার–কারাবাস, নির্যাতন, প্রতিপক্ষের আক্রমণ—এসব ঝুঁকি রাজনীতিকদের জীবনে থাকে। খালেদা জিয়াও এমন জুলুম–নির্যাতন সহ্য করেছেন। উপরন্তু সহ্য করেছেন স্বামী ও সন্তান হারানোর গভীর শোক আর দীর্ঘ রোগযন্ত্রণা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কঠিন এক পরিস্থিতিতে পড়েন তিনি। দেশ স্বাধীন করার প্রাণপণ লড়াইয়ে যুক্ত হয়ে পড়েন স্বামী জিয়াউর রহমান। দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে সংকটে পড়েন খালেদা জিয়া। এর–ওর সাহায্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ঠিকানা বদলে বদলে আত্মগোপন করে থাকেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে গঠিত হয়েছিল ৭ দলীয় ঐক্যজোট। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতির কাছে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি ‘এরশাদ হটাও’ শীর্ষক এক দফা আন্দোলন শুরু করেন।
১৯৭১ সালের ২ জুলাই সিদ্ধেশ্বরীর এক বাসা থেকে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে সেনানিবাসে যুদ্ধবন্দী করে রাখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। যুদ্ধের সেই ভয়াবহ দুর্বিষহ দিনগুলো অতিক্রম করতে হয়েছে একাকী (সূত্র: খালেদা: মহিউদ্দিন আহমদ)।
পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক জীবনে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব–সংঘাত ছাড়াও প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, লাঞ্ছনা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছে খালেদা জিয়াকে। বহুকালের অনেক স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের বাড়ি থেকে তাঁকে উচ্ছেদ করা হয় ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর। গণমাধ্যমের সামনে সেদিন তাঁকে অশ্রুসজল অবস্থায় দেখেছিল দেশবাসী। এমন অজস্র ঘটনায় পরম ধৈর্য, আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদা বজায় রেখেছেন। অনমনীয় দৃঢ়তায় অটল থেকে মাথা উঁচু করে যে জীবন তিনি অতিবাহিত করলেন, তা শুধু বর্ণাঢ্যই নয়। খালেদা জিয়ার এই চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁকে মহৎ চরিত্রগুলোর মতো মহীয়ান করে তুলেছে।
সংগত কারণেই এমন মানুষের চিরপ্রস্থানের সংবাদ দেশের জনসাধারণের মধ্যে গভীর শোক ও মর্মবেদনা জাগিয়েছে।
শৈশব
খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে। তাঁর বাবা ইস্কান্দার মজুমদারের বাড়ি ফেনী জেলার পরশুরামের শ্রীপুর গ্রামে। মা তৈয়বা বেগমের জন্ম পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার চন্দনবাড়িতে। তাঁদের তিন কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে খালেদা জিয়া তৃতীয়। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল খালেদা খানম। দেখতে অত্যন্ত সুন্দর ছিলেন বলে বাড়ির লোকেরা তাঁকে ‘পুতুল’ বলে ডাকতেন। সেটিই তাঁর ডাকনাম হয়ে যায়। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন সেন্ট জোসেফ কনভেন্টে। পরে দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চমাধ্যমিক) উত্তীর্ণ হন।
খালেদা খানমের বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থে বলা হয়েছে, শৈশব থেকেই তিনি পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। ফুলের প্রতি নিবিড় অনুরাগ ছিল। নিজের ঘর পরিচ্ছন্ন করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখতেন। পরবর্তী জীবনে তিনি ফুলের প্রতি এই অনুরাগ, পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাটি থাকার অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন। তাঁর রাজনীতিও তাঁর নিজের মতো সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল বলে অনেকে মনে করেন।
এক জীবনীকার বলেছেন ‘দেশের সব জায়গায় তিনি গেছেন। তিনি পরিশ্রমসাধ্য দীর্ঘ সফর করতে পারঙ্গম ছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের ১৪ দিন আগে তিনি সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছিলেন।’
বিয়ে, সংসার
সেনাবাহিনীর তরুণ ও চৌকস কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট দিনাজপুরের বালুবাড়িতে পৈতৃক বাড়িতে খালেদা খানমের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের প্রসঙ্গে তাঁর এক জীবনীকার লিখেছেন, ঘটক জিয়াউর রহমানকে বলেছিলেন, ‘আপনি যদি তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হন, তাহলে আপনার বাড়িতে বিজলিবাতির দরকার হবে না। পাত্রী এত রূপসী যে, তাঁর রূপের ছটায় সব অন্ধকার দূর হয়ে যাবে।’
ঘটকের এমন কথা শুনে জিয়াউর রহমান হেসেছিলেন এবং বিয়ে করতে সম্মত হন। বিয়ের পর থেকে খালেদা খানম ‘খালেদা জিয়া’ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন।
জিয়া-খালেদা দম্পতির দুই ছেলে। বড় ছেলে তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর। ছোটজন আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট। কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়াতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে দেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্যের গুলিতে শহীদ হন। মাত্র ২১ বছরের দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে ৩৬ বছর বয়সে খালেদা জিয়া অকাল বৈধব্য বরণ করেন।
পরিমিত আহার করতেন খালেদা জিয়া। ফল খেতে পছন্দ করতেন। বিশেষ করে নিয়মিত পেঁপের রস পান করতেন। প্রিয় খাবার ছিল সাদা ভাত, সবজি, মসুর ডাল ও মাছ। মাংস খেতেন, তবে তেমন পছন্দের ছিল না। শ্রোতা হিসেবে তিনি বেশ ভালো ছিলেন। অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। জীবনীকারেরা বলছেন, ‘প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ধীরে ধীরে বিচক্ষণ হয়ে ওঠেন’ (বেগম খালেদা জিয়া: জীবন ও সংগ্রাম, মাহফুজ উল্লাহ)।
রাজনৈতিক জীবন
মানুষের জীবনে বহু অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক ঘটনা ঘটে। খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াটাও তেমনই এক অনিবার্য আকস্মিকতার পরিণাম। জিয়াউর রহমান কখনো স্ত্রীকে রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করেননি। তাঁর প্রয়াণের পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন।
দলীয় শৃঙ্খলা ও নেতৃত্ব সমুন্নত রাখার পাশাপাশি এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনের ভেতর দিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রথমেই দলের শীর্ষ পদ পাননি। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ভাইস চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের পর বিএনপির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নিজের ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ৪১ বছরই দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির শীর্ষ নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এল সাফল্য
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে গঠিত হয়েছিল ৭ দলীয় ঐক্যজোট। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতির কাছে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি ‘এরশাদ হটাও’ শীর্ষক এক দফা আন্দোলন শুরু করেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন–সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে অনেকেরই পূর্বানুমান ছিল তাঁর বিরোধীপক্ষই বিজয়ী হবে। কিন্তু সেসব অনুমান মিথ্যা প্রমাণ করে বিএনপির বিজয় তাঁর নেতৃত্বকে প্রশ্নহীন করে তোলে।
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে শপথ নেন। তিনি ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় এবং ২০০১ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালে ও ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
খালেদা জিয়া ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মোট ২৩টি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করেছেন। কোনোটিতেই তিনি পরাজিত হননি। তাঁর এক জীবনীকার বলেছেন, ‘দেশের সব জায়গায় তিনি গেছেন। তিনি পরিশ্রমসাধ্য দীর্ঘ সফর করতে পারঙ্গম ছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের ১৪ দিন আগে তিনি সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছিলেন।’
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনে অনেক সাফল্য থাকলেও কিছু সমালোচনাও রয়েছে। বিশেষত দুর্নীতি দমনে তিনি তেমন সফল হননি বলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল অভিযোগ রয়েছে বিরোধীপক্ষ থেকে। কথিত ‘হাওয়া ভবন’ এবং দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুসারে (২০০১-২০০৫) টানা পাঁচ বছর বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তাঁর প্রশাসনের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে।
কারাবাস
খালেদা জিয়া জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও নির্যাতনের শিকার হন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২ জুলাই থেকে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেনানিবাসে বন্দী ছিলেন। জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর ১৯৮১ সালে সেনানিবাসের বাড়িতে তাঁকে কিছুদিন গৃহবন্দী রাখা হয়েছিল। ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামে আলোচিত কালপর্বে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাড়িতে গৃহবন্দী করা হয়। পরে সেখান থেকে সংসদ ভবনের একটি বাড়িকে সাবজেল ঘোষণা করে এক বছর সাত দিন তাঁকে কারাবন্দী রাখা হয়।
দুর্নীতির দুই মামলায় সাজা দিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে পাঠানো হয় খালেদা জিয়াকে। দুই বছরের বেশি সময় বন্দী ছিলেন সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া।
চিকিৎসা ও প্রয়াণ
চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা হয়েছিল। তাঁর স্বাস্থ্য অনেকটা উন্নত হয়েছিল। তবে নানাবিধ রোগের জটিলতা ও শরীর–মনে বহু ধকল সহ্য করে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। প্রায়ই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তেন। হাসপাতালে ভর্তিও করানো হতো। গত ২৩ নভেম্বর তাঁকে শেষবারের মতো ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এবার তিনি আর চিকিৎসায় সাড়া দিতে পারলেন না। মেনে নিলেন পরম সত্য। ‘দেশনেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত খালেদা জিয়া চিরবিদায় নিলেন তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে।