স্ত্রী ও দুই ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় জাহাঙ্গীর

স্ত্রী ও দুই সন্তান হারিয়ে জাহাঙ্গীর হোসেনের কান্না থামছে না । রোববার দুপুরে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার খিদিরপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

‘চোখের সামনে ট্রলারটা ডুবায় দিল। স্ত্রী ও ছেলে দুইটা পানিতে ডুইব্বা যাইতাছিল। ছেলেগো বাঁচানের লাইগা লাফ দিয়া ওগো হাত ধরছিলাম। একটা ঘূর্ণি আইসা আমারে নিচে নিয়া গেল। এরপর আমার সব শেষ হইয়া গেল। চোখের সামনে সব শেষ হয়ে গেল।’

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার খিদিরপাড়া এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন বিলাপ করতে করতে এসব কথা বলছিলেন। ট্রলারডুবির ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তিনি।

আজ রোববার দুপুরে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনেরা বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছেন জাহাঙ্গীরকে। তবে কোনো কিছুতেই তাঁকে বোঝানো যাচ্ছিল না। বিছানায় উঠে বসার শক্তিটুকু নেই জাহাঙ্গীরের শরীরে। ভাঙা গলায় কেঁদেই যাচ্ছেন তিনি। স্বজনেরা বিছানা থেকে তুলে বারবার জাহাঙ্গীরকে পানি পান করানোর চেষ্টা করছেন। পাশে বসে আছে তাঁর বড় ছেলে রাফিকুল ইসলাম (১২)।

স্বজনেরা বলেন, রোববার সকালে জাহাঙ্গীরের দুই ছেলে সাকিবুল ইসলাম (১০) ও সজিবুল ইসলামের (৪) দাফন সম্পন্ন হয়। পপি বেগমের (৩০) লাশ বিকেলের দিকে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গ থেকে নিয়ে আসা হয়। পপির দাফনও সম্পন্ন হয়েছে।

স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের নিয়ে শনিবার সকাল ৬টার দিকে পদ্মা নদীতে ঘুরতে বের হন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, পদ্মা নদীতে ঘুরে বাড়িতে ফিরতে তাঁদের রাত হয়ে যায়। তাঁদের ট্রলারটা বাড়ির দিকে ফিরছিল। যখন বাল্কহেডটা দেখলেন, তাঁর হাতের টর্চলাইটা দিয়ে ইশারা করেন। এরপরও বাল্কহেডটা সরাসরি নৌকার ওপর উঠিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন

তিনি আরও বলেন, ‘আমি দুইটা লাফ দিছি লাগুর পাই নাই, অল্পের লইগা পানি ঢুইক্কা গোতলাইয়া কইজানি লইয়া গেল গা। কত সুখের সংসার আমাগো। কত স্বপ্ন আছিলো আমাগো। পোলারা মানুষ অইবো। আমরা সুখে থাকমু। আমার সব স্বপ্ন ভাসায় লইয়া গেল গা। আমি কেমুন কইরা বাঁচমু!’

ডুবে যাওয়া ট্রলারটিকে ক্রেনের সাহায্যে তোলা হচ্ছে। রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার রসকাঠি এলাকায়
ছবি : প্রথম আলো

দুই ভাতিজাকে উপজেলার খিদিরপুর কবরস্থানে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়েছে বলে জানান জাহাঙ্গীর হোসেনের ছোট ভাই মো. উজ্জ্বল। তিনি বলেন, তাঁর দুই ভাতিজাসহ ছয়জনের কবর পাশাপাশি খোদাই করা হয়েছে। ভাবির লাশও একই কবরস্থানে দাফন করা হবে।

এলাকার আলামিন নামের এক ব্যক্তি বলেন, এক ঘরের তিনজন মানুষ একসঙ্গে মারা গেলেন। তাঁদেরই সহ্য হচ্ছে না। যাঁদের আপনজন আর নেই, তাঁরা কীভাবে সহ্য করবেন। তাঁরা কীভাবে এ শোক কাটিয়ে উঠবেন? যাঁদের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে, তাঁদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির দাবি জানান তিনি।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, গতকাল শনিবার রাত ৮টার দিকে ৪৬ জন যাত্রী নিয়ে লৌহজং উপজেলার রসকাটি এলাকায় বাল্কহেডের ধাক্কায় একটি ট্রলার ডুবে যায়। স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড, বিআইডব্লিউটিএর সদস্যরা ট্রলারটির উদ্ধারকাজ শুরু করেন। রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ডুবে যাওয়া স্থান থেকে এয়ার লিফটিং ব্যাগ, ক্রেন বোটের সাহায্যে ট্রলারটি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ আছে ৩ শিশু। গতকাল শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুন