অদম্য রাব্বি এবার লেখক

তোহ্ফাতুর রাব্বির (বামে) বইয়ের নাম ‘নির্বাসন’
ছবি: সংগৃহীত

তোহ্ফাতুর রাব্বির কথা মনে আছে? জন্মগতভাবে দৃষ্টিহীন বলে যাঁকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করতে চায়নি চট্টগ্রামের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে অবহেলার জবাব দিয়েছিলেন রাব্বি।

অদম্য রাব্বির সেই কীর্তি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়। পরে সেই প্রতিবেদনই স্থান করে নেয় ষষ্ঠ শ্রেণির ‘কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা’ নামের পাঠ্যবইয়ে।

নানা বাধা ডিঙিয়ে রাব্বি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। এবার তিনি লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।

চট্টগ্রামে এবারের একুশে বইমেলায় রাব্বির একটি গল্পের বই বের হয়েছে। খড়িমাটি প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বইটির নাম ‘নির্বাসন’।

বইটি রাব্বি উৎসর্গ করেছেন তাঁর বাবা মো. কামাল উদ্দিন ও মা তাহরীর-ই-শাহনাজকে।

তিনটি বড় গল্প দিয়ে বইটি সাজানো হয়েছে। গল্পগুলো হলো ‘কাজল ধোয়া বৃষ্টি’, ‘নীল জগতে একা একজন’ ও ‘গৃহত্যাগী সৌরভ’।

রাব্বির ভাবনা ও উপলব্ধি প্রখর, যার ছাপ রয়েছে তাঁর গল্পের বইয়ে।

রাব্বি তাঁর গল্পে তুলে ধরেছেন সম্পর্কের নানা সমীকরণ। পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক তাঁর গল্পে উঠে এসেছে। পাশাপাশি রয়েছে কদর্য দিকও।
ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতার তিনটি জীবনকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে গল্পের বইটি। যান্ত্রিকতার মোড়কে আঁটা বর্তমান সমাজের বাস্তবতাই তাঁর গল্পের মূল উপজীব্য।

রাব্বি বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি করছি। কবিতা লিখি, গল্প লিখি। এই প্রথম সাহস করে একটি গল্পের বই বের করালাম। বইয়ে তিনটি বড় গল্প আছে। গল্পগুলোতে সমাজবাস্তবতার চিত্র উঠে এসেছে।’

উচ্চশিক্ষা শেষ করতে রাব্বিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। চট্টগ্রামের সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করেন রাব্বি। এখানে অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়ার সুযোগ ছিল না। তাই নবম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য তাঁকে ও তাঁর অভিভাবকদের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুঁজতে হয়। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলে তাঁকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি করতে চাচ্ছিল না। ফলে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় তাঁকে।

একপর্যায়ে তৎকালীন নগর পুলিশের কমিশনারের সহযোগিতায় রাব্বি পুলিশ ইনস্টিটিউশন স্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকেই ২০১০ সালে মানবিক বিভাগে এসএসসি পাস করেন রাব্বি।

‘নির্বাসন’ বইটি তিনটি বড় গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড থেকে মানবিক বিভাগে ৭৫ জন জিপিএ ৫ পান। তাঁদের মধ্যে রাব্বি একজন। তাঁর বিদ্যালয় থেকে রাব্বিসহ মাত্র দুজন এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।

এসএসসি পরীক্ষায় রাব্বির সাফল্য নিয়ে প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ‘অবহেলার জবাব দিয়েছে রাব্বি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই তাঁর সংগ্রামের গল্প পাঠ্যবইয়ে স্থান করে নেয়।

সেই সংগ্রামী কিশোর এখন পরিণত তরুণ। তিনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষে তিনি দুই বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটি প্রশিক্ষণপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। সেখানে নেতৃত্ব (লিডারশিপ), উপস্থাপনা, লেখার দক্ষতা (রাইটিং স্কিল) প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

রাব্বি বলেন, ধরাবাঁধা কোনো কাজে তাঁর মন বসে না। কাজের মধ্যে আনন্দ খোঁজেন তিনি। তাই প্রশিক্ষণপ্রতিষ্ঠান খুলেছেন।

কাজ যা-ই করেন না কেন, লেখালেখিটা চালিয়ে যেতে চান রাব্বি।

শিক্ষক ও সহপাঠীরা বলেন, দৃষ্টির প্রতিবন্ধকতা রাব্বির অদম্য মনোভাব ও মেধাকে আটকাতে পারেনি। বরং তাঁর সংগ্রাম ও সৃজনশীলতাকে আরও বেগবান করেছে। যেকোনো কিশোর-তরুণের জন্যই রাব্বি অনুপ্রেরণার নাম। তাঁর যে গল্পের বই প্রকাশিত হলো, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রতিবন্ধকতা জয়ের শক্তি।

আরও পড়ুন