আট দিন পর হারানো মেয়েকে ফিরে পেলেন মা

চুরি হওয়ার আট দিন পর মেয়েকে ফিরে পেয়ে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে চুমু দেন মা। বৃহস্পতিবার নাটোরের গুরুদাসপুর থানায়
প্রথম আলো

দুই মাসের শিশুসন্তান তায়বা চুরি হওয়ার বেদনা ও অবুঝ মেয়েকে বুকের দুধ পান না করানোয় অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন মা সীমা খাতুন। অঝোর কান্নায় চোখের পানি শুকিয়ে হয়েছিলেন বাক্‌রুদ্ধ। ঠিকমতো খেতে ও ঘুমাতে পারছিলেন না তিনি।

শেষ পর্যন্ত নিখোঁজ হওয়ার আট দিন পর নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের একটি বাড়ি থেকে বুধবার গভীর রাতে শিশুটিকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।
এ সময় আটক করা হয়েছে শিশু চুরির সঙ্গে জড়িত শাকিলা খাতুন ও তাঁর স্বামী সাইদুল ইসলামকে। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুলিশের পক্ষ থেকে শিশু তায়বাকে তুলে দেওয়া হয় মা সীমা খাতুনের কোলে।

নারী পুলিশের দুই সদস্য গুরুদাসপুর থানা চত্বরে সীমা খাতুনের কোলে তায়বাকে তুলে দেন। এ সময় পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন সীমা। ফুটফুটে মেয়েটি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মায়ের মুখের দিকে। নির্বাক মা–ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে অশ্রুসিক্ত হন। মা-মেয়ের এমন ভালোবাসা ও অসীম মমতার দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করেন উপস্থিত পুলিশ সদস্য, সংবাদকর্মী ও গেটের বাইরে অপেক্ষায় থাকা শত শত উৎসুক মানুষ।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের মাঝপাড়া গ্রামে তফিজ উদ্দিন ও সীমা খাতুন দম্পতির মেয়ে তায়বা। ২৩ ডিসেম্বর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে এসে তায়বা চুরি হয়ে যায়। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা নারীকে অভিযুক্ত করে মামলা করেন তায়বার বাবা তফিজ উদ্দিন।

এদিকে শিশু তায়বা চুরির রহস্য উদ্‌ঘাটন নিয়ে নাটোর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে গুরুদাসপুর থানা চত্বরে আজ বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

সেখানে পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, হাসপাতাল চত্বর থেকে শিশু চুরির ঘটনাটি ছিল আলোচিত। পরিবারটির দুরবস্থা ও শিশুটিকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে টানা আট দিন নিরলসভাবে কাজ করেছে জেলার চৌকস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত চারটি স্পেশাল টিম। তারা হাসপাতাল ও পৌর শহরজুড়ে বসানো সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করেন। সিসিটিভির ফুটেজ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত সব তথ্য বাছাই করে নিরলস ও বিরতিহীনভাবে তৎপরতা চালায় পুলিশ। অবশেষে বুধবার গভীর রাতে জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার কালিকাপুর গ্রাম থেকে শিশু তায়বাকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শাকিলা খাতুন (৩৫) নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মায়ের কোলে মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য শিশু তায়বাকে নিয়ে আসেন পুলিশ সদস্যরা। বৃহস্পতিবার নাটোরের গুরুদাসপুর থানায়
প্রথম আলো

পুলিশ জানায়, অভিযুক্ত শাকিলা খাতুন পেশাদার চোর না হলেও পরিস্থিতির কারণে শিশু তায়বাকে চুরি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। দুই মাস আগে গুরুদাসপুরের একটি ক্লিনিকে অপারেশনের মাধ্যমে কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছিলেন শাকিলা। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ায় শাকিলার ট্রাকচালক স্বামী সাইদুল ইসলাম ক্ষুব্ধ হয়ে ক্লিনিকের পাওনা পরিশোধ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। নিরুপায় হয়ে শাকিলার জন্ম দেওয়া কন্যাশিশুকে এক নিঃসন্তান দম্পতিকে দত্তকের বিনিময়ে টাকা নিয়ে ক্লিনিকের পাওনা পরিশোধ করে বাড়ি ফেরেন। এর কিছুদিন পর স্বামী সাইদুল ইসলাম মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে চাপ সৃষ্টি করে শারীরিক নির্যাতনসহ তালাকের হুমকি দিতে থাকেন। দিশেহারা শাকিলা সংসার টেকাতে গুরুদাসপুর হাসপাতাল থেকে ২৩ ডিসেম্বর শিশু তায়বাকে কৌশলে চুরি করে নিয়ে যান।

পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, মায়ের কোলে তায়বাকে ফিরিয়ে দিতে পেরে তাঁরা আনন্দিত। এতে বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। পুলিশ দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সব সময় অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফেরাতে কাজ করে যাচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সহকারী পুলিশ সুপার (সিংড়া-গুরুদাসপুর সার্কেল) জামিল আকতার, গুরুদাসপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবদুর রাজ্জাকসহ মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা।

মেয়েকে ফিরে পেয়ে তায়বার বাবা তফিজ উদ্দিন বলেন, ‘সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় ছিলাম। মেয়েকে পেয়ে আমরা ভীষণ আনন্দিত।’ মেয়েকে ফিরে পাওয়ার ঘটনায় পুলিশ ও সাংবাদিকদের ধন্যবাদসহ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে অভিযুক্ত শাকিলার শাস্তি দাবি করেছেন।

গুরুদাসপুর থানার ওসি আবদুর রাজ্জাক বলেন, শিশু চুরির বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তৎপরতা চালিয়েছে জেলা পুলিশ। সিসিটিভির ফুটেজ ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে দ্রুততম সময়ে শিশু উদ্ধার ও আসামিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। প্রচলিত আইনে করা মামলায় শাকিলা খাতুনকে আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে জেলা কারাগারে।

আরও পড়ুন