আমার অনশন চলবে বিচার না হওয়া পর্যন্ত

পুলিশের নির্যাতনে মারা যাওয়া রায়হান আহমদের মা ছালমা বেগম বন্দরবাজার ফাঁড়ির সামনে রোববার থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেছেন
প্রথম আলো

‘ছেলেকে হত্যার পর থেকে এমনিতেই আমি স্বাভাবিক নই, খাওয়া থেকে শুরু করে ঘুম পর্যন্ত নেই। দলমত–নির্বিশেষ দাবি জানাচ্ছে নির্যাতনের মূল হোতা বরখাস্ত এসআই আকবরকে গ্রেপ্তার করার। কিন্তু আকবরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। এই দুঃখে আমি আজ সকালে এক গ্লাস পানি খেয়ে অনশনে বসেছিলাম। শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনশন ভাঙলেও আমার অনশন চলবে বিচার না হওয়া পর্যন্ত।’

সিলেট নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে রোববার টানা ছয় ঘণ্টার অনশন শেষে রোববার বিকেলে পুলিশি হেফাজতে মারা যাওয়া রায়হানের মা ছালমা বেগম প্রথম আলোকে এসব কথা বলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ছেলের হত্যার বিচার চেয়ে রোববার বেলা ১১টার দিকে অনশন বসেন পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে নিহত মো. রায়হান আহমদের মা ছালমা বেগম। তাঁর সঙ্গে পরিবারের সদস্যরাও একাত্ম হন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ছালমা অসুস্থতা বোধ করেন। খবর পেয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, রায়হানের এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মখলিছুর রহমানসহ সিটি করপোরেশনের অন্যান্য ওয়ার্ড কাউন্সিলর এসে ছালমা বেগমকে পানীয় পান করে অনশন ভঙ্গ করান।

এর আগে অনশন চলাকালে বন্দরবাজার ফাঁড়ির সামনে সিলেট নগরীর কেন্দ্রস্থলের প্রধান সড়ক অবরোধ করে রাখেন রায়হানের মায়ের অনশনে সংহতি প্রকাশ করা লোকজন।

ছালমা বেগমকে পানীয় পান করে চিকিৎসকের কাছে পাঠন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘পুলিশ ফাঁড়িটি নগর ভবনের পাশেই। সকাল থেকে রায়হনের মা অনশন করছেন। অথচ তাঁকে পুলিশ কিংবা পিবিআই কেউ এসে কোনো আশ্বাস দিচ্ছে না। আমি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নিয়ে এই মাকে আশ্বস্ত করেছি যে নগরের একজন সেবক হিসেবে তাঁর দাবির সঙ্গে আমরা সবাই একাত্ম।’ মেয়র বলেন, মায়ের মন, তাই তিনি পাগলপারা। ঘটনার দুই সপ্তাহ পরও প্রধান অভিযুক্ত গ্রেপ্তার না হওয়াটা আসলেই একটি খারাপ বার্তা। এই শহরকে শান্ত রাখতে হলে অবশ্যই পলাতক আকবরসহ সবাইকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা উচিত।

আরও পড়ুন

সিলেট নগরীর একটি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে চাকরি করতেন রায়হান। স্ত্রী, আড়াই মাস বয়সী এক মেয়ে, মাসহ যৌথ পরিবার নিয়ে তিনি আখালিয়ার নিহারিপাড়ার বসবাস করতেন। ১০ অক্টোবর দিবাগত রাত তিনটার দিকে রায়হানকে সিলেট কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে রায়হান মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী তাহমিনা আক্তার পরদিন ১১ অক্টোবর হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন।

রায়হানের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগ আনা সাইদুরকে রোববার সকালে পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর কথা সন্দেজনক হওয়ায় মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

এ ঘটনায় পরদিন ওই পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আকবরসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করে পুলিশ। আকবর ১৩ অক্টোবর থেকে পলাতক। পুলিশ থেকে মামলাটির তদন্তের ভার পিবিআইয়ে হস্তান্তর হলে রায়হানের লাশ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত হয়। নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ফাঁড়ির ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ক্লিপ গায়েব, তথ্য গোপন করাসহ বরখাস্ত এসআই আকবরকে পালাতে সহায়তা করার দায়ে ২১ অক্টোবর ফাঁড়ির ‘টু-আইসি’ পদে থাকা এসআই হাসান উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

ছিনতাইয়ের অভিযোগ তোলা ব্যক্তি গ্রেপ্তার

রায়হানের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগ আনা শেখ সাইদুর রহমান নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ১০ অক্টোবর রাতে সাইদুরের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই রায়হানকে ফাঁড়িতে তুলে এনেছিল পুলিশ। এ তথ্য প্রত্যক্ষদর্শী তিন কনস্টেবলের আদালতে জবানবন্দিতে প্রকাশ পায়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই পরিদর্শক মহিদুল ইসলাম বলেন, রায়হানের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগ আনা সাইদুরকে রোববার সকালে পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর কথা সন্দেজনক হওয়ায় মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এ নিয়ে মামলায় মোট গ্রেপ্তার হলেন তিনজন। এর মধ্যে দুজন বরখাস্ত হওয়া কনস্টেবল। তাঁরা দুজন রিমান্ডে আছেন।