কিশোরকে হত্যার পর ক্যামেরা নিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা

কিশোর উজ্জ্বলকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার সৈয়দ এহসান ও খসরু মিয়া
সংগৃহীত

করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় শ্রমজীবী বাবাকে সহায়তা করতে ক্যামেরা হাতে পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে ট্যুরিস্ট গাইড ও ফটোগ্রাফারের কাজে নেমেছিল স্কুলছাত্র উজ্জ্বল মিয়া (১৩)। সেই ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতেই হত্যা করা হয় উজ্জ্বলকে। তাকে হত্যার অভিযোগে দুই তরুণকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ সোমবার বিকেলে সৈয়দ এহসান (২২) ও খসরু মিয়া (১৮) নামের ওই দুজন হত্যার দায় স্বীকার করে সিলেটের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সিলেটের গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল আহাদ এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জবানবন্দির পর দুজনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এহসানের বাড়ি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জের ধরমপুর গ্রামে। জাফলংয়ে একটি খাবারের রেস্তোরাঁর কর্মী ছিল। উজ্জ্বলের হাতে নতুন ক্যামেরা দেখে এহসান ক্যামেরাটি ছিনিয়ে নেওয়ার ফন্দি করেন। এ কাজে যুক্ত করেন একই গ্রামের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই খসরু মিয়াকে।

যে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য হত্যা, সেই ক্যামেরাই তাঁদের ধরিয়ে দিয়েছে, জবানবন্দিতে এ রকম কথা উল্লেখ করে দুজন বলেন, জাফলংয়ের প্রবেশমুখে পুলিশের তল্লাশিচৌকি এলাকা একটি ট্রাকে করে পেরোতে গিয়ে ধরা পড়েন।

নিহত উজ্জ্বল মিয়া জাফলং আমির মিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার বাবার নাম আবদুস সাত্তার। তিনি পেশায় পাথরশ্রমিক। সিলেটের জাফলংয়ের রসুনপুর গ্রামে স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। উজ্জ্বল তাঁর বড় ছেলে। গতকাল রোববার দুপুরে জাফলংয়ের মায়াবী ঝরনা এলাকা থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় উজ্জ্বলকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। উজ্জ্বলের পিঠে ২৩টি ছুরিকাঘাতের ক্ষত পেয়েছে পুলিশ। এ সময় তার ক্যামেরা ও মুঠোফোন পাওয়া যায়নি।

পুলিশ জানায়, রোববার বেলা তিনটার দিকে উজ্জ্বল মারা যাওয়ার পর জাফলংয়ের প্রবেশমুখের গুচ্ছগ্রামে তল্লাশিচৌকি বসানো হয়। সেখানেই একটি ট্রাকে করে পালানোর সময় এহসান ও খসরু ধরা পড়েন। এ সময় ট্রাকচালক ও চালকের সহকারীকেও আটক করে পুলিশ। এহসান ও খসরুর কাছ থেকে উজ্জ্বলের ক্যামেরা ও রক্তমাখা পোশাক উদ্ধার করে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে এ দুজনই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। পরে দুজনই উজ্জ্বলকে হত্যার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেন। এ ঘটনায় রোববার রাতে গোয়াইনঘাট থানায় এহসান ও খসরুকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন নিহত উজ্জ্বলের বাবা আবদুস সাত্তার। সোমবার দুপুরে দুজনকে আদালতে হাজির করলে তাঁরা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

উজ্জ্বল মিয়া
সংগৃহীত

জবানবন্দিতে দুজন বলেছেন, রোববার সকালে তাঁরা পর্যটক সেজে উজ্জ্বলের কাছে জানতে চান মায়াবী ঝরনা কত দূর। উজ্জ্বল তখন মায়াবী ঝরনায় পানি নেই বলে এড়িয়ে যেতে চান। তখন তাঁকে সেখানে ছবি তুলে দিলে দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার লোভ দেখান। উজ্জ্বল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁদের নিয়ে মায়াবী ঝরনা রওনা দেয়। সেখানে গিয়ে উজ্জ্বলের ক্যামেরায় অসংখ্য ছবি তোলেন তাঁরা। বেলা একটার দিকে ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখতে তাঁরা ক্যামেরাটি হাতে নেন। এ সময় দুজন কিছু সময় ওই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলেন। দাম জিজ্ঞেস করে ক্যামেরাটি তাঁরা ব্যাগে রাখেন। উজ্জ্বল ক্যামেরাটি ফেরত চাইলে তখন লাথি মেরে ক্যামেরা নিয়ে দুজন পালানোর চেষ্টা করেন।

জাফলংয়ের মায়াবী ঝরনা এলাকায় শীতকালে পানি না থাকায় পর্যটকদের সংখ্যা কম হয়। এই সুযোগে দুপুরবেলা সেই স্থানটি অনেকটা নির্জন থাকায় উজ্জ্বলকে হত্যার তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা করেন এহসান ও খসরু। জবানবন্দিতে তাঁরা বলেন, কয়েকটি লাথি দেওয়ার পরও উজ্জ্বল এহসানের পা ধরে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে। তার চিৎকার থামাতে বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে রেখে পিঠে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন। এ সময় উজ্জ্বল নিথর হয়ে পড়ে থাকলে তাঁরা মায়াবী ঝরনা এলাকা থেকে জাফলং ফেরেন।

জবানবন্দিতে দুজন বলেন, জাফলং ফিরে এসে দুজন রক্ত লেগে থাকা পরনের কাপড় বদল করেন। পর্যটকের একটি ব্যাগে উজ্জ্বলের ক্যামেরা নিয়ে পর্যটক বেশে কিছু সময় ঘোরাঘুরি করে দেখেন ঘটনাটি জাফলংয়ের অন্যান্য ফটোগ্রাফার ও পুলিশ জেনে গেছে। তখন একটি সেলুনে দুজন চুল কেটে অবয়ব পরিবর্তন করেন।

যে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য হত্যা, সেই ক্যামেরাই তাঁদের ধরিয়ে দিয়েছে, জবানবন্দিতে এ রকম কথা উল্লেখ করে দুজন বলেন, জাফলংয়ের প্রবেশমুখে পুলিশের তল্লাশিচৌকি এলাকা একটি ট্রাকে করে পেরোতে গিয়ে ধরা পড়েন। তাঁদের সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে পুলিশ ক্যামেরা ও মুঠোফোন পায়। ক্যামেরায় উজ্জ্বলের তোলা অসংখ্য ছবি দেখে সন্দেহ হয় পুলিশের। একপর্যায়ে পুলিশের কাছে স্বীকার করেন ঘটনাটি।

সিলেটের পর্যটনকেন্দ্র জাফলং
ফাইল ছবি

গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল আহাদ বলেন, ১৫ জুলাই জাফলংয়ের গ্রিন পার্কে ট্যুরিস্ট গাইড ও ফটোগ্রাফার সাদ্দাম হোসেনকে (৩০) একই কায়দায় হত্যা করে ক্যামেরা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার অভিজ্ঞতায় তাৎক্ষণিক তল্লাশিচৌকি স্থাপন করায় এহসান ও খসরুকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হওযা গেছে। তাদের পালাতে সহায়তা করায় ট্রাকচালক ও চালকের সহকারীকেও মামলায় আসামি করা হবে।

আরও পড়ুন