বিরহের গান গেয়ে কোটি মানুষের হৃদয় জয় করা সুকুমার বাউল ভালো নেই। গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে গানের আসর ও রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় নিদারুণ কষ্টের দিন। এ বছরের জানুয়ারিতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও নতুন করে লকডাউনে চরম সংকটে পড়েছেন গান গেয়ে সংসার চালানো এই বাউল।
সুকুমার বাউলের ভাষায়, ‘খুব বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন যাচ্চে। করোনাভাইরাসের কারণে গানের আসরে ডাক পড়িচ্চে না, সব বন্ধ। হাতত টেকা নাই। আর চলবার পারিচ্চি না, লজ্জায় কারো কাছে চাইতেও পারছি না, খিদা সইতেও পারছি না। ইঙ্গকা অবস্থা আরও চলতে থাকলে তো না খায়্যাই মরা লাগবি!’
‘বলব না গো, আর কোনো দিন ভালোবাসো তুমি মোরে’ গান গেয়ে পরিচিতি পাওয়া সুকুমার মহন্তের বাড়ি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামে। লকডাউনের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে দরিদ্র এই বাউলের পরিবারের ওপর। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ পরিবারের আট সদস্যের মুখে ভাত তুলে দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। এখন প্রহর গুনছেন কবে করোনাকাল শেষ হবে, কবে আবার আসরে গান গাইতে পারবেন।
গতবারও করোনায় খুব দুর্দিনে পড়েছিলেন। অনাহারে থাকার খবর পেয়ে প্রশাসন সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল। কিন্তু এবার কেউ এখনো খোঁজখবর নেননি।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে কথা হয় সুকুমার বাউলের সঙ্গে। তিনি জানান, লকডাউনের কারণে গানের আসর বন্ধ থাকায় উপার্জন বন্ধ। এতে আর্থিক সংকটে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চরম কষ্টে দিন কাটছে তাঁর। হাতে জমানো টাকা ভেঙে এই কদিন সংসারের খরচ চালিয়েছেন। এখন হাতে টাকা ফুরিয়েছে। ঘরে চাল-ডাল, তেল, লবণ, আলু কিছুই নেই।
সুকুমার বাউলকে প্রশ্ন করি, গানের আসর তো বন্ধ, কেমন করে সময় কাটছে? তিনি বলেন, গান আর গলাটা হলো বেঁচে থাকার অবলম্বন। গানের আসর বসলে গলায় সুর ওঠে, গলা চললে পেট চলে। এক বছর ধরে গানের আসর প্রায় বন্ধ, সে কারণে গলাতেও সুর নেই। উপার্জনও বন্ধ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই গানের আসরে ফিরতে হবে। পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আবার গান গাইতে হবে।
বৈশাখ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ইউটিউবে একাধিক গান রিলিজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা আর লকডাউনে সব বন্ধ। সর্বশেষ মাস তিনেক আগে একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ‘মিষ্টি মিষ্টি কথা কইয়া/ মন নিয়াছ কাড়িয়া’ গানটি করেছিলেন সুকুমার।
তিনি জানালে, গত বছরের বৈশাখী উৎসবে দুটি অনুষ্ঠানে গানের বায়না পেয়েছিলেন। কিছু টাকাও অগ্রিম দিয়েছিলেন আয়োজকেরা। কিন্তু করোনার কারণে উৎসব বন্ধ হয়। সেই অনুষ্ঠান হয় এ বছরের জানুয়ারিতে। কিন্তু চুক্তির পুরো টাকা আর দেননি আয়োজকেরা। এ বছর বৈশাখী উৎসবের জন্য প্রচুর বায়না এসেছিল। কিন্তু করোনার প্রকোপে বায়না নেওয়ার সাহস পাননি। এরপর লকডাউন শুরুর পর বৈশাখী উৎসব ও চৈত্রসংক্রান্তির মেলা বন্ধ হওয়ায় গানের আসরও বন্ধ। এখন ঘরবন্দী জীবন। করোনার যে পরিস্থিতি জ্যেষ্ঠ মাসে গানের আসর বসার কোনো আশা নেই। এরপর তো বর্ষাকাল। সেই হিসেবে এবারও কোনো গানের আসর আর হবে না।
বিয়ানবেলা কোনো দিন অ্যাকনা মরিচমাখা পান্তাভাত আর রাতে শুকনো মুড়ি খেয়ে দিন যাচ্চে। মানুষের কাছে হাত পাতিনি কখনো। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?
বাউল সুকুমারের ছয় সদস্যের গানের দল আছে। ঢোলে সমীর, দোতরায় আসিফ, বাঁশিতে ফাহিম, খঞ্জনিতে হাফিজ ছাড়াও আরও দুজন বাদ্যযন্ত্রী। ফোন পেলেই গান গাইতে তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যেতেন সুকুমার বাউল। কিন্তু আসর বন্ধ থাকায় তাঁদেরও দিন পার করা কঠিন হয়ে গেছে। সুকুমার বাউল বলেন, ‘করোনা হামাক শ্যাষ করে দিল। গানের আসর বন্ধ, পথত বসে গেলাম। নিজের প্যাটই চলে না, দলের সদস্যদের চালাই ক্যামনে?’
সুকুমার বাউলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গতবারও করোনায় খুব দুর্দিনে পড়েছিলেন। অনাহারে থাকার খবর পেয়ে প্রশাসন সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল। কিন্তু এবার কেউ এখনো খোঁজখবর নেননি। সুকুমার বাউলের আক্ষেপ, ‘বিয়ানবেলা কোনো দিন অ্যাকনা মরিচমাখা পান্তাভাত আর রাতে শুকনো মুড়ি খেয়ে দিন যাচ্চে। মানুষের কাছে হাত পাতিনি কখনো। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? গান ছাড়া বউ–ছল লিয়ে হামি বাচমু ক্যাংকা করে। গান ছাড়া আর কিছুই তো পারি না?’
বছর দুয়েক আগে ‘বলব না গো, আর কোনো দিন ভালোবাসো তুমি মোরে’ গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। আলোচিত এই গান মাত্র কয়েক মাসে শুধু একটি ইউটিউব চ্যানেলেই দেখা হয় কোটিবার। সেই সময়ে নিভৃতচারী সুকুমার বাউলকে নিয়ে ২০১৯ সালের ১৬ মার্চ প্রথম আলো ছুটির দিনে ‘বলেছিলে গো, ভালোবাসি গো’ শিরোনামে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। এরপর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সুকুমার বাউলের নাম।