ধরমপাশায় তিন গ্রামে শোকের ছায়া, স্বজনদের আহাজারি

নেত্রকোনার কলমাকান্দার গুমাই নদে পৌনে ১০টার দিকে একটি যাত্রীবাহী ট্রলারডুবি হয়। এ ঘটনায় নিহত ১০ জনের ৯ জনের বাড়িই সুনামগঞ্জের ধরমপাশায়। লাশগুলো গ্রামের বাড়িতে আনার পর স্বজনদের আহাজারিতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

নেত্রকোনার কলমাকান্দায় বুধবার সকালে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে।প্রথম আলো

নেত্রকোনার কলমাকান্দায় যাত্রীবাহী ট্রলারডুবিতে নিহত ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের বাড়িই সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলায়। তাঁরা ধরমপাশার তিনটি গ্রাম ইনাতনগর, কামাউড়া ও জামালপুর গ্রামের বাসিন্দা। ট্রলারডুবিতে নিহত এই নয়জনের লাশ নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে আনার পর স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। শোকবিহ্বল স্বজনদের কান্নায় উপস্থিত গ্রামবাসীর চোখেও দেখা যায় জল।

আরও পড়ুন

আজ বুধবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে কলমাকান্দার বড়খাপন ইউনিয়নে রাজনগর গ্রামলাগোয়া গুমাই নদে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় ৩০-৩৫ জন যাত্রী বহনকারী ট্রলারটির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় একটি বালুবাহী নৌকার। এ ঘটনায় প্রাণ হারানো ১০ জন হলেন সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার জামালপুর গ্রামের কবীর মিয়ার স্ত্রী সুলতানা বেগম (৪০) ও তাঁর তিন বছরের ছেলে আল মুজাহিদ, একই উপজেলার কামাউড়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী লাকি আক্তার (৩০) ও তাঁর আড়াই বছরের ছেলে জাহিদ মিয়া, চার বছরের মেয়ে টুম্পা আক্তার, একই এলাকার ছায়েদ আলীর স্ত্রী মর্জিনা আক্তার (৫০), আলমগীরের ছয় বছরের ছেলে অনিক মিয়া, আবদুল ওয়াহাবের স্ত্রী লুৎফুন্নাহার (২৫) ও তাঁর দুই বছরের ছেলে রাকিবুল এবং নেত্রকোনার মেদনী এলাকার আবু চানের স্ত্রী হামিদা আক্তার। এখনো নিখোঁজ রয়েছে আরও চারজন।

নেত্রকোনার কলমাকান্দার ট্রলারডুবিতে নিহতদের স্বজনদের আহাজারি। আজ দুপুরে।
সংগৃহীত

ট্রলারডুবিতে নিহত ধরমপাশার মধ্যনগর ইউনিয়নের ইনাতনগর গ্রামের গৃহবধূ লুৎফুন্নাহারের স্বামী আবদুল ওয়াহাব কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার এক ছেলে ও এক মাইয়াসহ স্ত্রীরে লইয়া বারহাট্টা উপজেলার ধোবালা গ্রামের ভায়রার বাড়িতে বেড়ানিত যাইতে চাইছিলাম। এই বেড়ানিই আমরার কাল অইলো। আমি আমার পাঁচ বছর বয়সী মাইয়ারে লইয়া ছোট্টু ট্রলারডার এককোনাত আছিলাম। আরেক পাশে আছিল আমার স্ত্রী ও দুই বছরের ছেলে রাকিবুর। ট্রলারডাত হঠাৎ একটা ঝাঁকি মারল। আমার মাইয়ারে লইয়া কুনুরহমে ট্রলারের ওফুরে উইঠা বাঁচার লাইগ্যা ট্রলার থাইক্যা লাফ মারছি। এই সময় মাইয়াডা আমার গলা ছাইড়া দিলে হে তল অইয়া গ্যাছে। হেরে আর খুঁইজা পাইছি না। ট্রলারডা হানিত ডুইবা যাওয়ায় আমার স্ত্রী ও ছেলেরে খুঁইজা ফাইছি না। ফরে স্ত্রী ও ছেলের লাশ খুঁইজা পাইলেও মাইয়াডা অহনো নিখোঁজ আছে। এই শোক আমি কী করে সইবাম...।’

একই ইউনিয়নের কামাউড়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী লাকী বেগম (৩০) তাঁর চার বছর বয়সী মেয়ে টুম্পা আক্তার ও আড়াই বছর বয়সী ছেলে জাহিদ মিয়াকে নিয়ে বারহাট্টা উপজেলার দেবীপুর গ্রামে ছোট বোন জামাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁদের বেড়ানো আর হলো না। ট্রলারডুবিতে নিহত হন তিনজনই। ওই গ্রামের ষাটোর্ধ্ব গৃহিণী ফুলবানু বেগম বলেন, ‘লাকী বেগম আমার চাচাতো ভাইয়ের বউ। সে দুই সন্তানকে নিয়ে তার ছোট বোনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে চেয়েছিল। এখন ফিরে এল লাশ হয়ে।’

মধ্যনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আরশাদ মিয়া বলেন, ‘ট্রলারডুবিতে নিহত মর্জিনা আক্তার (৫০) সম্পর্কে আমার চাচি হন। তিনি নেত্রকোনা সদর উপজেলার কর্ণপন্না এলাকায় তাঁর জামাতার বাড়িতে বেড়াতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতেই হলো সর্বনাশ। আমাদের ইউনিয়নে এত মানুষের লাশ আমরা এর আগে কখনো দেখিনি।’

বুধবার সকাল সাড়ে সাতটার সিরিয়ালে যে ট্রলারটি দেওয়ার কথা ছিল, সেটি অন্য জায়গায় ভাড়ায় পাঠিয়ে দিয়ে ট্রলার লাইন নিয়ন্ত্রক কামাউড়া গ্রামের আবদুল হালিম এই ছোট্ট ট্রলারটি লাইনে দিয়েছেন। এটির কোনো ফিটনেস কিংবা ট্রলারে কোনো নিরাপত্তাসামগ্রী ছিল না।

ইনাতনগর গ্রামের বাসিন্দা মাহবুব আলম বলেন, ‘যে ট্রলারটি ডুবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, সেটি ছোট্ট একটি ট্রলার। এই লাইনে এই ছোট্ট ট্রলারটি আগে কখনো দেখিনি। বুধবার সকাল সাড়ে সাতটার সিরিয়ালে যে ট্রলারটি দেওয়ার কথা ছিল, সেটি অন্য জায়গায় ভাড়ায় পাঠিয়ে দিয়ে ট্রলার লাইন নিয়ন্ত্রক কামাউড়া গ্রামের আবদুল হালিম (৩৫) এই ছোট্ট ট্রলারটি লাইনে দিয়েছেন। এটির কোনো ফিটনেস কিংবা ট্রলারে কোনো নিরাপত্তাসামগ্রী ছিল না। এই ছোট ট্রলারের কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। এ ট্রলারডুবির ঘটনায় আমাদের মধ্যনগর ও পাইকুরাটি ইউনিয়নের তিনটি গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।’

ট্রলারডুবিতে নিহতদের পরিবারের হাতে সহায়তা তুলে দিচ্ছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ। আজ বিকেলে ধরমপাশার মধ্যনগর ইউনিয়নের ইনাতনগর গ্রামে।
সংগৃহীত

মধ্যনগর বাজার থেকে ঠাকুরকোনা রুটে ট্রলারের লাইন নিয়ন্ত্রক আবদুল হালিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পাইকুরাটি ইউপি চেয়ারম্যান ফেরদৌসুর রহমান বলেন, ‘ট্রলারডুবিতে নিহত আমার ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের সুলতানা বেগম (৪৫) ও তাঁর নাতি চার বছর বয়সী আল মুজাহিদ ঠাকুরকোনার এক আত্মীয়র বাড়িতে যেতে চেয়েছিলেন। সেই যাওয়া আর হলো না।’

ধরমপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবু তালেব বলেন, এ ঘটনা নেত্রকোনা এলাকায় ঘটেছে। কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে, তা খুঁজে বের করার জন্য নেত্রকোনার জেলা প্রশাসন থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা হয়েছে। নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমান ও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ মহোদয় সরেজমিনে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের জন্য নগদ ২০ হাজার টাকা ও শুকনো খাবার সহায়তা দেওয়া হয়েছে। নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার টাকা করে অর্থসহায়তা।