পিবিআইয়ের হাতে আটক গৃহকর্তা স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার কথা স্বীকার করলেন

নরসিংদীর বেলাবতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার অভিযোগে গিয়াস উদ্দিন শেখকে আটক করেছে পিবিআই
ছবি: প্রথম আলো

নরসিংদীর বেলাব উপজেলায় এক নারী ও তাঁর দুই সন্তানের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় গৃহকর্তাকে আটক করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গৃহকর্তা গিয়াস উদ্দিন শেখ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যার কথা স্বীকার করেছেন।

আজ রোববার বিকেল ৪টার দিকে পিবিআইয়ের জেলা পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আটকের পর গিয়াস উদ্দিন শেখ জিজ্ঞাসাবাদে মৌখিকভাবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন এবং হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন। ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের উপর্যুপরি পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। আমরা এখন তাঁকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও ব্যাটসহ অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এর বিস্তারিত জানানো হবে।’

এর আগে আজ বেলা ১১টার দিকে উপজেলার পাটুলী ইউনিয়নের বাবলা গ্রামের বাড়ি থেকে লাশ তিনটি উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় নিহত তিনজন হলেন গিয়াস উদ্দিন শেখের স্ত্রী রাহিমা বেগম (৩৫) এবং তাঁদের দুই সন্তান রাব্বি শেখ (১৩) ও রাকিবা শেখ (৭)। রাহিমা বেগম এলাকায় কাপড় সেলাইয়ের দরজি হিসেবে পরিচিত। রাব্বি স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ঝরে পড়া ছাত্র ও রাকিবা স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী।

গিয়াস উদ্দিন শেখ (৪৫) বেলাব উপজেলার পাটুলী ইউনিয়নের বাবলা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি গাজীপুরের কাপাসিয়ার আড়াল এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টেন্ডারের মাধ্যমে রঙের কাজ করেন। তিনি বেশির ভাগ সময় গাজীপুরে অবস্থান করেন। আর দুই সন্তানকে নিয়ে রাহিমা বেগম গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। গতকাল শনিবার বিকেলে গিয়াস উদ্দিন গাজীপুরের কর্মস্থলে যান। স্ত্রী ও দুই সন্তানের লাশ পড়ে থাকার খবর পেয়ে তিনি আজ সকাল ১০টার দিকে গাজীপুর থেকে বাড়িতে যান।

স্থানীয় লোকজন বলেন, আজ সকাল আটটার দিকে স্থানীয় এক নারী বানাতে দেওয়া পোশাক আনতে যান রাহিমা বেগমের বাড়িতে। বাইরে থেকে দরজা আটকানো দেখে বেশ কয়েকবার নাম ধরে সজোরে ডাকাডাকি করেন তিনি। কিন্তু আশপাশ থেকেও কারও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে কৌতূহলবশত দরজার নিচ দিয়ে ঘরের ভেতরে তাকান তিনি। এ সময় তিনি রক্ত দেখতে পেয়ে চিৎকার দেন। তখন স্থানীয় লোকজন ও প্রতিবেশীরা এসে ওই ঘরের একটি জানালা ভেঙে ঘরের ভেতর লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর বেলাব থানা-পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বেলাব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাফায়েত হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান ঘটনাস্থলে আসার পর লাশ উদ্ধারের কাজ শুরু হয়। এ সময় দুই ঘরের দরজা খুলে নিহত তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

পিবিআই বলছে, আটকের পর গিয়াস উদ্দিন শেখ তাঁদের কাছে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন। গিয়াস উদ্দিন বলেছেন, গতকাল রাতে তিনি গোপনে বাড়িতে আসেন। পরে স্ত্রী রাহিমা বেগমের কক্ষে ঢুকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁকে পেটান। এরপর মেঝেতে ফেলে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন তিনি। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত দুই সন্তানদের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ওই ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন। পরে দুই ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকে রেখে তিনি চলে যান।

পিবিআই জানায়, কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড, সে বিষয়ে নিজেদের মতো করে তদন্ত করছিল ডিবি, র‍্যাব, সিআইডি, পিবিআই ও পুলিশ কর্মকর্তারা। গিয়াস উদ্দিন শেখও তাদের তদন্তে সহযোগিতা করছিলেন। কিন্তু তাঁকে খুবই নির্বিকার লাগছিল। স্বাভাবিক ছিলেন তিনি। প্রথমে তাঁকে সন্দেহ হয়নি। তিনি পিবিআইকে জানান যে তিনি ঘটনার সময় গাজীপুরে ছিলেন। পরে তদন্তের জন্য তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বর ট্র্যাক করে পিবিআই জানতে পারে, হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন। এরপরই সন্দেহ থেকে তাঁকে আটক করা হয়। আটকের পর জেরার মুখে তিনি পিবিআইয়ের কাছে মৌখিকভাবে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার কথা স্বীকার করেন।

বাড়িটিতে পাশাপাশি লাগোয়া দুটি মাটির ঘর। পশ্চিম দিকের ঘরটিতে থাকতেন রাহিমা বেগম। দক্ষিণ দিকের ঘরে থাকত রাব্বি ও রাকিবা। নিজ নিজ ঘরেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। রাহিমা বেগমের রক্তাক্ত লাশ পড়ে ছিল ঘরের মেঝেতে। অন্যদিকে রাব্বি ও রাকিবার লাশ পড়ে ছিল তাদের খাটের ওপরে। বাড়িটির সামনেই বিশাল খোলা মাঠ। অন্তত ৫০ গজ দূরত্বে দুই দিকে দুটি বাড়ি আছে। আশপাশে আর কোনো বাড়িঘর নেই।

আটকের আগে গিয়াস উদ্দিন শেখের অভিযোগ ছিল, ১০-১২ দিন আগে বাড়িতে কয়েকটি গাছ কেটেছিলেন তিনি। এ নিয়ে তখন তাঁর এক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়। ওই চাচাতো ভাই তাঁদের গাছগুলো বিক্রি করতে দেননি। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক বাড়লে তিনি হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন। তবে আটকের পরে পিবিআইয়ের কাছে তাঁর ভাষ্য, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে চাচাতো ভাইকে ফাঁসাতে গিয়ে তিনি এই কাণ্ড করেছেন।

পিবিআই নরসিংদীর পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সময় গাজীপুরে ছিলেন জানালেও আমরা তাঁর মোবাইল ট্র্যাক করে জানতে পারি তিনি ওই সময় ঘটনাস্থলেই ছিলেন। এ ছাড়া একজন নারীর সঙ্গে তাঁর মুঠোফোনে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার বিষয়টিও আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এই দুই কারণে আমরা তাঁকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করি। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আমাদের কাছে মৌখিকভাবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। এরপরই তাঁকে আটক করা হয়।’