বাবার ওষুধ ও ভাতের জন্য আর ভিক্ষা করতে হবে না আকলিমাকে

তথ্যমন্ত্রীর অনুদানে বাবা-মেয়ের জন্য দুটি রিকশা ভ্যান ও পাঁচ হাজার টাকা দেন পঞ্চগড় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাতপ্রথম আলো

অসুস্থ বাবার ওষুধ ও নিজেদের জন্য ভাতের জোগাড় করতে আর ভিক্ষা করতে হবে না আকলিমাকে। এই বাবা-মেয়ের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদসহ ঢাকার এক ব্যবসায়ী এবং যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টাপ্রবাসী এক বাংলাদেশি। আকলিমার চোখে-মুখে এখন খুশির ঝিলিক। সে এখন স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করতে চায়।

৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণে ‘বাবার ওষুধ ও ভাতের জন্য ভিক্ষা করে মেয়েটি’, এমন শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। এরপর অনেকে ফোন করে তাদের খোঁজখবর নেন ও সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন।

অসুস্থ বাবা মো. হেলালকে নিয়ে পঞ্চগড়ে মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলস্টেশন এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকে আকলিমা। কাঁচা বাসায় প্রতি মাসে ভাড়া দিতে হয় ৭০০ টাকা।

হেলালের পৈতৃক বাড়ি ছিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায়। ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। তাঁর প্রথম স্ত্রীর পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। দ্বিতীয় বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে সাভার এলাকায় আলাদা থাকতেন হেলাল। সেখানেই জন্ম হয় আকলিমার। তার বয়স যখন দুই বছর, তখনই ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আকলিমার মা নাসিমা আক্তার। এরপরই ছোট মেয়েকে নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন হেলাল।

দীর্ঘদিন আশপাশের লোকজনের কাছে মেয়েকে রেখে কাজে যেতেন তিনি। অনেক কষ্টে মেয়েকে বড় করে স্থানীয় একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। তিন বছর আগে হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, চোখে কম দেখাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন তিনি। ফলে আর কাজ করতে পারেন না। এরপর চলে যান দিনাজপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে থেকে প্রায় দুই বছর সাহায্য তুলে কোনো রকমে চলছিল বাবা-মেয়ের জীবন। এরপর সেখানেও থাকা হয়নি তাঁদের। এক বছর আগে চলে আসেন পঞ্চগড় রেলস্টেশন এলাকায়।

মাঝেমধ্যে হেলাল মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য তুললেও এখন অসুস্থতার কারণে আর তেমন বের হতে পারেন না। পুরো সংসারের চাপ পড়ে যায় আকলিমার ওপর। প্রতিদিন বাবার জন্য পুরোনো ব্যবস্থাপত্রে লেখা ৬৫ টাকার ওষুধ আর খাবার জোগাড় করতে সকাল হলেই ভিক্ষার থলি নিয়ে বের হতে হয় আকলিমাকে। বিকেলে বাড়ি ফিরে রান্না করে বাবার সামনে দিতে হয় তাকে।

বাবা-মেয়েকে নিয়ে লেখা প্রথম আলোর প্রতিবেদন তথ্যমন্ত্রীর নজরে এলে তিনি অনুদান পাঠান। আজ শনিবার দুপুরে তাঁর পক্ষ থেকে আকলিমাদের বাড়িতে গিয়ে বাবা-মেয়ের জন্য দুটি রিকশা ভ্যান ও পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন পঞ্চগড় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত।

আনোয়ার সাদাত বলেন, ‘মেয়েটির ভিক্ষা করার সংবাদ প্রথম আলোতে প্রকাশের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের নজরে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়েটিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি দেশের বাইরে থাকায় আমার মাধ্যমেই তিনি এই সহায়তা পাঠিয়েছেন। মেয়েটির স্কুলে ভর্তিসহ তার বাবার চিকিৎসার খোঁজখবর আমরা রাখব। এ ছাড়া বাবা-মেয়েকে সরকারিভাবে একটি স্থায়ী মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়ার চেষ্টা করব।’

প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই স্থানীয় এক ব্যক্তি আকলিমাদের জন্য এক বস্তা (৫০ কেজি) চাল দিয়ে যান। এরপর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক ব্যবসায়ী এবং যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টাপ্রবাসী এক বাংলাদেশি আকলিমার লেখাপড়াসহ তার বাবার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। ইতিমধ্যে স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় আকলিমার বাবাকে নতুন করে চিকিৎসক দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। স্কুল খুললেই স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির করে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন শিক্ষকেরা।

আরও পড়ুন

সহায়তা পেয়ে আকলিমা আক্তার বলে, ‘অনেকেই আমাকে সহযোগিতা করতেছেন। আমরা নতুন করে বাবাকে ডাক্তার দেখাইছি। বাবা মোটামুটি ভালো আছেন। আমি চাই স্কুলে ভর্তি হতে। পড়ালেখার সুযোগ পেলে আমি মানুষের মতো মানুষ হতে চাই।’

হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘মেয়েটা সারা দিন শহরে ভিক্ষা করে বেড়াত। এইটা সাংবাদিকের চোখে পড়েছিল। পরে নাকি পেপারে দিছেন। এখন অনেকেই আমাদের খোঁজ নেন। সাহায্য করতে চান। তথ্যমন্ত্রীও দুইটা ভ্যান আর টাকা পাঠাইছেন। যাঁরা এভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের জন্য দোয়া করি।’ ভ্যান দুটি অন্যদের কাছে ভাড়া দেবেন বলে তিনি জানান।

আকলিমাকে সহায়তাকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘মেয়েটি বাবার ওষুধের জন্য ভিক্ষা করে সংবাদটি পড়ে খুবই খারাপ লেগেছে। আমি মেয়েটির পড়ালেখাসহ অন্য খরচের জন্য প্রতি মাসে সহায়তা করতে চাই। আমি চাই না আর এক দিনের জন্য এই ছোট্ট মেয়েটি ভিক্ষা করুক।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টাপ্রবাসী ওই বাংলাদেশি মুঠোফোনে বলেন, ‘মেয়েটির জন্য বড় মায়া হয়। মাত্র ১২ বছর বয়সী একটি মেয়ে এভাবে ভিক্ষা করবে, তা হতে পারে না। আমরা কয়েকজন মিলে মেয়েটিকে সহায়তা করতে চাই। সেই সঙ্গে সমাজের বিত্তবানদেরও মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে তার স্থায়ী চলার ব্যবস্থার অনুরোধ জানাই।’