‘মানুষ সব রাইখা জান বাঁচাইছে আগে’

বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে ঘরের বেড়া। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার গণেশপুর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

‘পানি বাড়তে বাড়তে একসময় ঘরের ভেতর গলাপানি অইছে। পানিত খুব স্রোত। বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি। রাইতের অন্ধকারে কোনোমতে বউ-বাচ্চারে নিয়া বাইর অইয়া আইছি। ঘরের সব জিনিসপত্র বানের পানিত ভাইসা গেছে। আমি এখন পথের ফকির।’ এভাবেই বন্যায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন সুনামগঞ্জ শহরের সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ে পরিবারসহ আশ্রয় নেওয়া দিনমজুর আবু মিয়া (৫৫)। আজ মঙ্গলবার সকালে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। এই আশ্রয়কেন্দ্রে শহর ও শহরতলির শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

আরও পড়ুন

ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিসহ আবু মিয়ার পরিবারের নয়জন গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আছেন এখানে। আবু মিয়া বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে পানি বাড়তে থাকে। পানি একেবারে ঘরে ঢুকে যাবে এটা চিন্তা করতে পারেননি। বিকেল থেকে শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। সন্ধ্যায় ঘরের ভেতর ঢুকে যায় পানি। রাত নয়টার দিকে ঘরে কোমরপানি হওয়ার পর সবাইকে নিয়ে চিন্তায় পড়েন। একপর্যায়ে দেখেন, নদীর প্রবল স্রোত ঢুকছে ভেতরে। তখন ভাবেন আর রক্ষা নাই। এই অবস্থাতে খালি হাতেই সবাইকে নিয়ে বের হন। কোনো রকমে রাস্তায় ওঠেন। দেখেন সেখানেও কোমরপানির স্রোত যাচ্ছে। সবকিছু অন্ধকার। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত মাথায় নিয়েই প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পানি ভেঙে এসে ওঠেন জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ে।

আরও পড়ুন

আবু মিয়ার বড় ছেলে হাসান আলী (৩০) নির্মাণশ্রমিক। হাসান আলী বলেন, তাঁরা ভাড়া থাকেন শহরের নবীনগর এলাকায়। পানি কমার পরে ঘরে গিয়ে দেখেন সামনে, পেছনের দরজা খোলা। ঘরের ভিতর দিয়ে বন্যার পানির স্রোত বয়ে গেছে।। মেঝে-বেড়া তছনছ হয়ে আছে। আসবাবপত্র সব ভেঙেচুরে একাকার। কাপড়চোপড়, হাঁড়িপাতিল ভেসে গেছে।

আবু মিয়ার স্ত্রী সফিনা বেগম (৫০) বলেন, ‘এক কাপড়ে আইছিলাম। ভিজা কাপর পরনে শুকাইছে। এক কাপড়েই আছি। ঘরও যাইতাম পাররাম না। সরকারে না দেখলে বাঁচতাম না।’

আরও পড়ুন

এই আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা হোসেন আলী (৬০), জাহানারা বেগম (৪৫), জমিরুল হকসহ (৫২) অনেকেই জানান, তাঁরা বাড়ি থেকে খালি হাতে কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন। তাঁদের জিনিসপত্র বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাড়িঘর ভেঙে গেছে। বাড়িঘরে এখনো পানি। শিগগিরই বাড়িতে ফেরার সুযোগ নেই।

আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা শহরতলির মইনপুরের বাসিন্দা রিফাত আলী (৫৬) বলেন, ‘অবস্থা দেইখা মনে অইছিল কিয়ামত শুরু অইছে। মানুষ সব রাইখা জান বাঁচাইছে আগে। এখন চিন্তাত কিলা ঘরবাড়ি নিয়া। মানুষের তো সব গেছে। বানে কোমর ভাঙিলিছে।’
সুনামগঞ্জ শহরের স্কুল, কলেজ ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের বেশির ভাগই দরিদ্র, শ্রমজীবী। তাঁদের কারও কাঁচা, কারও টিনের চাল ও বেড়ার ঘর। পানিতে স্রোত থাকায় ঘরবাড়ির বেশি ক্ষতি হয়েছে। ইচ্ছে করলেই মানুষ সহজে বাড়িতে ফিরতে পারছে না।

সুনামগঞ্জে এখন পানি কিছুটা কমেছে। শহর থেকে পানি নামছে। গত মাসের ১৩ তারিখ প্রথম দফা বন্যা হয়। মানুষ এই বন্যার ধকল সইতে না সইতেই ১০ জুন থেকে আবার শুরু হয় ভারী বৃষ্টি। একই সঙ্গে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নামে ব্যাপক পরিমাণে পাহাড়ি ঢল। ১৩ জুন থেকে আবার বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো। ১৫ মে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা পুরোটাই প্লাবিত হয়। ১৬ জুন পানি প্রবেশ করে সুনামগঞ্জ পৌর শহরে। দুপুর থেকে শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে পুরো শহর প্লাবিত হয়ে যায়। রাতে মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকেন। রাত পোহাবার আগেই শহরে পাঁচ-ছয় ফুট পানিতে তলিয়ে যায়।