শ্বাসকষ্ট নিয়ে জনাব আলীও ট্রলিতে উঠেই লাশ হলেন

মুখের অক্সিজেন খুলে ট্রলিতে তুলে ওয়ার্ডে নেওয়ার পথে অবস্থা খারাপ হলে ফের জরুরি বিভাগে এনে অক্সিজেন দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে জনাব আলীকে। মঙ্গলবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
প্রথম আলো

বেলালুজ্জামানের মতো জনাব আলীও ট্রলিতে উঠে ছুটেছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডের উদ্দেশ্যে। শ্বাসকষ্ট বাড়ছিল। বাঁচার জন্য চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে ওয়ার্ডে যাওয়ার পথেই জনাব আলী মারা যান। একইভাবে ১৫ জুন ট্রলিতে উঠে করোনা ওয়ার্ডে যাওয়ার পথে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন বেলালুজ্জামান নামের আরেকজন রোগী।

এভাবে শ্বাসকষ্ট নিয়ে এসে অনেক রোগীই করোনা ওয়ার্ডে যাওয়ার পথেই মারা যাচ্ছেন। আবার কেউ ওয়ার্ডে গিয়ে মারা যাচ্ছেন। আবার কেউ ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়ার পরপরই মারা যাচ্ছেন।

জনাব আলী রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার সায়বাড় গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। কাজ করতেন উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। স্বজনদের ভাষ্যমতে, তাঁর রক্তচাপ কমে গিয়েছিল। ডায়াবেটিস ছিল। দুই দিন ধরে ছিল জ্বর। মঙ্গলবার সকালে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জনাব আলীকে জরুরি বিভাগে এনেই অক্সিজেন মাস্ক পরানো হয়। জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত ব্রাদারেরা করোনা ইউনিটের কোনো ওয়ার্ড ফাঁকা আছে খোঁজ নিতে থাকেন। এদিকে জরুরি বিভাগে জনাবের অক্সিজেন চলতে থাকে।

ইসিজি করে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে যখন মৃত ঘোষণা করা হলো, তখন বেলা ১১টা বেজে ৫ মিনিট।

রোগীর স্বজনেরা ১, ৩, ২৯ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরেও কোথাও ফাঁকা শয্যা পাননি। তখন জরুরি বিভাগ থেকে রোগীকে করোনা ইউনিটের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বলা হয়। অক্সিজেন মাস্ক খুলে রোগীকে ট্রলিতে তুলে রওনা দেন স্বজনেরা। মাঝপথে রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্ট। তাই আবারও জরুরি বিভাগের দিকে ট্রলি ঘুরিয়ে দৌড় দেন স্বজনেরা। জরুরি বিভাগে যখন ট্রলি পৌঁছায় তখনো জনাবের শ্বাস চলছিল। কিন্তু অক্সিজেন মাস্ক লাগাতে লাগাতেই তিনি মারা গেলেন।

ইসিজি করার ব্যবস্থা না থাকায় জরুরি বিভাগের নার্স তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করতে পারেননি। ইসিজি করতে পাঠালেন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে ইসিজি করে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হলো। তখন বেলা ১১টা বেজে ৫ মিনিট।

জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত নার্সিং কর্মকর্তা আসাদুল হক বলেন, অক্সিজেন ছাড়া রোগীকে ওয়ার্ডের দিকে নিয়ে যাওয়ায় ঠিক হয়নি। অক্সিজেনের অভাবেই রোগীটা মারা গেল। এমন জটিল পরিস্থিতিতে রোগীর অক্সিজেন মাস্ক খুলে কেন ওয়ার্ডে পাঠানো হলো জানতে চাইলে আসাদুল রোগীর স্বজনদের ঘাড়েই দোষ চাপালেন। বললেন, ‘এত তাড়াহুড়ো করা ঠিক না। জরুরি বিভাগেই আরেকটু অক্সিজেন দেওয়া যেত।’

আরও পড়ুন

অ্যাম্বুলেন্সে লাশ তোলার পর ছেলে মইনুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালে চিকিৎসা নাই ভাই।’

১৫ জুন নাটোরের সিংড়ার বেলালুজ্জামানকে বেলা ১১টা ১১ মিনিটে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রলিতে তোলা হয়েছিল। ১১টা ৪৭ মিনিটে তাঁর লাশ নিয়ে ট্রলি ফিরে আসে। সময়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ৩৬ মিনিট। এর আগে ১৯ জুন দুর্গাপুর উপজেলার কৃষক শামসুল হককে হাসপাতালের ওয়ার্ডে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেড় ঘণ্টার বেশি সময় তাঁকে বাঁচানো যায়নি।

গত ১১ জুন সকালে চারঘাট উপজেলার চককাপাশিয়া গ্রামের মোস্তফা আলীও প্রায় একইভাবে মারা যান। তিনি জরুরি বিভাগে এসে ছটফট করছিলেন। তাঁকে অক্সিজেন দেওয়ার কোনো লোক ছিল না। জরুরি বিভাগের অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে নিজেই নাকে অক্সিজেন নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পরে তাঁকে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে দেওয়া হয়। সেখানেও তাঁকে অক্সিজেন দেওয়ার কেউ ছিলেন না। কিছুক্ষণ পরে তিনি ওয়ার্ডেই মারা যান। এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী অবশ্য সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ওই রোগীর হয়তো অন্য সমস্যা ছিল। সে জন্য তিনি ছটফট করছিলেন। তাঁর অক্সিজেন মাত্রা ভালো ছিল।