সেই শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে বিনা মূল্যে টিকার নিবন্ধন

বিনা মূল্যে টিকা নিবন্ধন করে দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। মালদাপাড়া গ্রাম, বেড়া, পাবনা, ৩ মার্চ
প্রথম আলো

টিফিনের টাকায় পথচলা পাবনার বেড়া উপজেলার সেই শিক্ষার্থীরা এবার চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের বিনা মূল্যে টিকার জন্য নিবন্ধন ও পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন করছে। গত চার দিনে উপজেলার তিন শতাধিক মানুষের নিবন্ধন করেছে তারা।

এবারের টিকা নিবন্ধন কর্মসূচিতে শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠন নামের একটি সংগঠনের প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে উপজেলার চরাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে চলে যাচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে থাকছে স্মার্টফোন। এর সাহায্যে প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে আগ্রহীদের সহজেই নিবন্ধন করে দিচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধনে আগ্রহীদের শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র ও মুঠোফোন নিয়ে আসতে হচ্ছে। নিবন্ধনের পর স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থীরা উপজেলা সদরে ফিরে গিয়ে টিকা কার্ড প্রিন্ট করে নিবন্ধিত ব্যক্তিকে দিয়ে আসছে। টিকা কার্ড প্রিন্ট করাসহ সার্বিক ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন তাদের সহযোগিতা করছে।

ওই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছর পাঁচেক আগে ঐতিহ্যবাহী সরকারি বেড়া বিপিন বিহারী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে গঠন করে শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠন নামের মানবকল্যাণমুখী সংগঠন। তারা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে শুরু করে মানবকল্যাণমুখী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। শুরুর দিকে ওরা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা–সংক্রান্ত সহায়তাসহ দুস্থদেরও নানাভাবে সহায়তা করেছে। যেখানেই ওরা মানুষের অসহায়ত্বের খবর পেয়েছে, সেখানেই ওরা পৌঁছে গিয়ে দুস্থদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী, চিকিৎসাসামগ্রী, শীতবস্ত্র প্রভৃতি বিতরণ করেছে।

মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ওদের আকুলতায় মুগ্ধ হয়ে এখন অনেক সচ্ছল ও ধনাঢ্য ব্যক্তি ওদের তহবিলে অর্থসহ বিভিন্ন সামগ্রী দান করছেন। বর্তমানে সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেড়া উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিক্ষার্থী। করোনা দেখা দেওয়ার পর তারা এক হাজারের বেশি কর্মহীন মানুষকে খাবার দিয়ে সহায়তা করেছে। এবারের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণও করেছে। সম্প্রতি তারা একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য আধা পাকা ঘর নির্মাণ করে দিয়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

দুস্থদের সেবার পাশাপাশি সংগঠনের শিক্ষার্থীরা এখন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে করোনার টিকা নিবন্ধনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এ সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়ার চাপ কম। এই সুযোগে তিন দিন ধরে তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ও সচেতন করে তুলছে। এতে টিকা নিতে কেউ ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁর নিবন্ধন করে দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

ওই সংগঠনের শিক্ষার্থী বলে, অনেকের মধ্যেই টিকা সম্পর্কে নানা ভুল ধারণা রয়েছে। এসব মানুষকে বোঝাতে চরম বেগ পেতে হচ্ছে। ফলে গত চার দিনে তারা মাত্র তিন শতাধিক টিকার নিবন্ধন করতে পেরেছে। তবে শিক্ষার্থীরা নিবন্ধনের জন্য ওই সব এলাকায় না গেলে এগুলোর একটিও নিবন্ধন হতো না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচিতে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহা. সবুর আলী। তিনি শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে উপজেলার দুটি থানার ওসিসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানদের চিঠি দিয়েছেন। নিবন্ধনের পর শিক্ষার্থীদের তাঁর কার্যালয়ে বিনা মূল্যে টিকা কার্ড প্রিন্ট করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এতে শিক্ষার্থীরা নিবন্ধনের পর ইউএনওর কার্যালয় থেকে টিকা কার্ড প্রিন্ট করে নিবন্ধনকারীদের বাড়ি গিয়ে তা পৌঁছে দিচ্ছে।

যমুনার চরে অবস্থিত চরনাগদা গ্রামের লিয়াকত আলী (৬৫) বলেন, ‘লোকমুখে শুনিছিল্যাম টিকা নিলি নাকি সমস্যা হয়। কিন্তু ছাত্ররা আইস্যা এই ধারণা ভাইঙ্যা দিল। ওরা আমার রেজিস্টি কইর্যা কাগজ দিয়্যা গেছে। কাল যায়া টিকা নেব।’

ওই সংগঠনের সভাপতি মেহেরাব হোসেন বলে, ‘প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ এমনিতেই নানা গুজব ও ভুল ধারণার কারণে টিকা নিতে আগ্রহী নন। এর ওপর কারও আবার টিকা নিতে ইচ্ছা হলেও নিবন্ধনের ব্যবস্থা না থাকায় তিনি টিকা নিতে পারছেন না। আমরা প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের এ দুটি প্রতিবন্ধকতা দূর করার চেষ্টা করছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে টিকার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ছে।’

ইউএনও মোহা. সবুর আলী বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগেও টিকা নিবন্ধন ও প্রদানের ব্যাপারে আমরা জেলায় অষ্টম স্থানে ছিলাম। কিন্তু ওই সংগঠনের সদস্যরা নিবন্ধনে সহায়তায় করায় এখন আমরা জেলায় পঞ্চম স্থানে আছি। শিক্ষার্থীদের এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে আমরা টিকা নিবন্ধন ও প্রদানে আরও এগিয়ে যাব বলে আশা করছি।’