‘সেতু চালুর পর আমগো ব্যবসা আরও ভালো অইবো’

দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন মঞ্জু মিয়া। ছবি গত শুক্রবার বিকেলে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে এক দিন আগে গত শুক্রবার শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া পর্যন্ত ফেরিপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ জন্য এ রুটে চলাচল করা বাসসহ অন্যান্য যানবাহন রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া-মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া রুটে ফেরিতে পদ্মা নদী পাড়ি দেয়। এতে দৌলতদিয়া ঘাটে ওই দিন সকাল থেকেই যানবাহনের দীর্ঘ সারি তৈরি হয়। ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েন হাজারো যাত্রী।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। এরপর রাত গড়িয়ে ভোর, কিন্তু যানবাহনের যাত্রী এবং ট্রাকচালকদের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। শুক্রবার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা এই ঘাটে আটকে থাকার অলস সময়ে কথা হয় সিদ্ধ ডিম বিক্রেতা মঞ্জু মিয়ার (৫০) সঙ্গে। তিনি প্রায় ১৫ বছর এই ঘাটে ও ফেরিতে সেদ্ধ ডিম বিক্রি করে সংসার চালান। বেচাবিক্রির ফাঁকেই কথা হলো মঞ্জু মিয়ার সঙ্গে। পদ্মা সেতু চালু হলে তো এই ফেরিতে ভিড় অনেক কমে যাবে; তাতে ব্যবসা তো মন্দা হয়ে যাবে—এমন প্রশ্ন করতেই মঞ্জু মিয়া যেন এ নিয়ে একেবারেই ভাবলেশহীন। সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে লবণ মাখাতে মাখাতে বলেন, ‘এইতে আমগো ব্যবসা আরও ভালো অইবো।’

কিছুটা বিস্ময় নিয়ে আবার প্রশ্ন করি, কীভাবে? মঞ্জু সহজ-সরল ভঙ্গিতে এবার বললেন, ‘দ্যাহেন, অহন বাসগুলান ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির লাইগা অপেক্ষা করে। যাত্রীরা বাসথন নাইমা হোটেলে পছন্দমতো খাওন খাইতে পারে। ঘাটে জাম (জ্যাম) না লাগলে তহন চলতি গাড়িতে যাত্রীরা হাতের ধারে যা পাইবো, তা–ই খাইবো। আমগো ব্যবসা আরও ভালো অইবো তহন।’ মঞ্জু মিয়ার কথায় যুক্তি আছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হলেও পদ্মা সেতু তাঁদের জীবন-জীবিকায় কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, এরই মধ্যে তা ভেবে রেখেছেন তাঁরা। তাই সেতু হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের যাত্রীরা এ পথে না এলেও তাঁদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

আরও পড়ুন

বরিশাল থেকে দৌলতদিয়া-আরিচা হয়ে ঢাকার দূরত্ব ২৭৭ কিলোমিটার। আর জাজিরা-মাওয়া হয়ে ফেরিপথে এই দূরত্ব ১৮৮ কিলোমিটার। অর্থাৎ এই পথে ঢাকার দূরত্ব ৮৯ কিলোমিটার বেশি। কিন্তু জাজিরা থেকে মাওয়ায় ফেরি পারাপারে সময় বেশি লাগা এবং দীর্ঘ যানজট আর ভোগান্তির কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ যানবাহন এত দিন দৌলতদিয়া-আরিচা হয়েই যাতায়াত করত। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এখন আর এই ২১ জেলার যানবাহন দৌলতদিয়া-আরিচার পথে যাবে না।

আরিচার এই বৃহৎ ফেরিতে খাবার ও অন্য মালামাল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন—এমন লোকের সংখ্যা অন্তত ৩০০। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এসব ক্ষুদ্র পেশাজীবী যে সংকটের গভীর খাদে পড়বেন—এমন আশঙ্কাই ছিল সবার। এমনকি এ পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কেউ কেউ এমন আশঙ্কার কথা বলছিলেন। কিন্তু মঞ্জু মিয়ার মুখে এমন আশার কথা শুনে আশাবাদী হওয়ার প্রেরণা মিলল।

আরও পড়ুন

ডিম বিক্রির ফুরসতে মঞ্জু মিয়া জানান, তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল গোয়ালন্দের পদ্মাপাড়ে। কিন্তু প্রমত্ত পদ্মার তীব্র ভাঙন বাড়িঘর ধুয়েমুছে তাঁদের ভিটাহারা করেছে। এরপর তিনি স্ত্রী ও চার মেয়ে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি জমিতে। সেখানে ছোট্ট ঘর তুলে মাথা গুঁজেছেন। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এখন তিন মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার চলে মোটামুটি। সেদ্ধ ডিম বিক্রি করে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ টাকা রোজগার করেন। কিছু টাকা জমিয়ে এবং ধারদেনা করে প্রতিবছর একটি গরু লালন-পালন করেন। কোরবানিতে বিক্রি করে হাজার বিশেক টাকা লাভ হয় এতে। আর দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে সেখানে বোরো ধানের আবাদ করেন। এতে বছরের খোরাক হয়ে যায়। এভাবে সংসারটাকে টেনে নিচ্ছেন একাই।

কথা শেষ করে আরেক ক্রেতার কাছে যেতে যেতে মলিন মুখে মঞ্জু বলছিলেন, ‘আমরা খুব অসহায়, আমাগোর খুব কষ্ট। কিন্তু জীবন তো থামনের না, চালাইতে অইবো, এই তো চলছে...।’

আরও পড়ুন