সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের নেতারা। তাঁরা বলছেন, বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম, গাফিলতির কারণেই হাওরে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। যাঁরাই অনিয়ম করেছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
সংগঠনের পক্ষ থেকে আজ মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান নেতারা। পৌর শহরের একটি সংবাদপত্র কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে এ সংবাদ সম্মেলন হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, একের পর এক হাওরে ফসলহানি ঘটছে। অথচ এই ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত তথ্য নিয়ে লুকোচুরি চলছে। একইভাবে হাওরে এখনো অর্ধেক ধান কাটা হয়নি। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, ৭০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। এই তথ্যও ঠিক নয়। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুয়ায়ী, এখন পর্যন্ত জেলার ১৯টি হাওরে ৫ হাজার ৭৬৫ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের তথ্য বলছে, প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ক্ষতি হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের এ বছর প্রায় ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। শুরুতে কৃষকদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চারিত হলেও এখন পাহাড়ি ঢলে তাঁদের সোনালি ধান তলিয়ে যাচ্ছে। শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে ফাটল ও ধস দেখা দেওয়ায় গভীর উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে কৃষকদের। বাঁধ ভেঙে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও প্রশাসন, কৃষি বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত তথ্য তুলে ধরছেন না। সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক মন্ত্রী হাওর পরিদর্শনে এসে অনিয়ম-দুর্নীতির পক্ষে ছাপাই গাইছেন। এতে কৃষকেরা হতাশ হয়েছেন।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২ এপ্রিল তাহিরপুর উপজেলার ২৪ নম্বর প্রকল্পের নজরখালির বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্তত ১ হাজার ২০০ হেক্টর কাঁচা ধান তলিয়ে যায়। ৪ এপ্রিল ছাতক উপজেলার গোয়া-পান্ডুয়া, নাগা উন্দা, পুটিয়া ও জল্লার হাওরের ৭১ হেক্টর, বাঁধ উপচে বাঘার হাওরের ৪২৫ হেক্টর জমির ধানের ক্ষতি হয়েছে। পরের দিন ৫ এপ্রিল নদীর পানি উপচে কৈয়ারবনন্দ ও পুটিয়ারবন্দ হাওরের ৪০ হেক্টর, ধর্মপাশা উপজেলার ৭৫, ৭৬, ৯২, ৯৩ নম্বর প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে চন্দ্রসোনার থাল হাওরের প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমির ফসলহানি ঘটে। ৬ এপ্রিল নদীর পানি উপচে শাল্লা উপজেলার গোবরহরি হাওরের ৪০ হেক্টর ও দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের ১৬ নম্বর প্রকল্পের বৈশাখীর বাঁধ ভেঙে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। ৮ এপ্রিল তাহিরপুর উপজেলার ফল্লিয়ারদাইড় বাঁধ উপচে এরালিয়াকোনা হাওরে পানি ঢুকে। এতে ক্ষতি হয় ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির। একই দিন মধ্যনগর উপজেলার পাওধোয়া বাঁধ ভেঙে মুক্তারখলা হাওরের ৯৬৫ হেক্টর জমির ফসলহানির ঘটনা ঘটে।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, ১৭ এপ্রিল গুরমার হাওরের বর্ধিত অংশের ২৭ নম্বর প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে হাওরের ২ হাজার হেক্টর, দিরাই উপজেলার হুরামন্দিরা হাওরের ৪২ নম্বর প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে ১ হাজার ২০০ হেক্টর, শান্তিগঞ্জ উপজেলার আইডরা বিল, পুরাইডরা, নউল্লা, বইশমারা, বারকুল, সিলাইন, ডাবরবিল, মরা ডাবরের ৪৮৫ হেক্টর, জগন্নাথপুর উপজেলার গলাকাটা হাওর ও শেওরারবন হাওরে নদীর তীর উপচে ৩২৫ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে যায়। ২০ এপ্রিল মধ্যনগরের ইন্দরপুর বাঙ্গালভিটার বাঁধ ভেঙে রাঙ্গামাটির হাওরের ১০০ হেক্টর, জগন্নাথপুরের হাপাতির হাওরের ১০০ হেক্টর, আহমদাবাঁধ হুন্দাবিললের ৭৫ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। ২১ এপ্রিল কোন্দানাল ব্রিজের পুটিয়ার হাওরের বাঁধ ভেঙে ছাতক ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। ২৪ এপ্রিল শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরের ৮১ নম্বর প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। সর্বশেষ আজ জামালগঞ্জ উপজেলার বৃহৎ হালির হাওরের বাঁধ ভেঙেছে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের হিসাব অনুযায়ী, ২ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল জেলার ছোট-বড় ৩১টি হাওরের ১৭ হাজার ৪৭৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করার চেষ্টা করছে। এখনো হাওরের ৫০ শতাংশ ধান কাটা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি সুখেন্দু সেন ও চিত্তরঞ্জন তালুকদার, সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে কুদরত পাশা, প্রচার সম্পাদক আনোয়ারুল হক, সদস্য এমরানুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি ইয়াকুব বখত, সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদনূর আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৫ হাজার ৭৬৫ হেক্টর জমির ধান। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতি কম বা জমির ধান কাটার পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ সত্য নয়। আমি নিজেও প্রতিদিন মাঠে ঘুরছি। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিদিনের হিসাব থেকেই প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে।’