সুনামগঞ্জে বাঁধ ভেঙে ডুবছে হালির হাওরের ধান

বাঁধ ভেঙে ডুবছে কৃষকের শ্রমে-ঘামে ফলানো সোনার ধান। ছবিটি আজ দুপুরে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরের আহসানপুর এলাকা থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে কৃষকের সোনার ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। ফসলি হাওরের মধ্যে জেলার বড় হাওরগুলোর একটি হালির হাওর। এ হাওরে প্রায় আট হাজার হেক্টর ফসলি জমি আছে।

স্থানীয় কৃষকেরা জানান, গতকাল সোমবার রাতে উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের আহসানপুর এলাকার একটি বাঁধের নিচ দিয়ে প্রথমে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি ঢুকতে থাকে। রাতেই বাঁধটি ভেঙে বৌলাই নদের পানি তীব্র বেগে হাওরে ঢুকতে থাকে। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর কৃষকেরা হাওরে ছুটে যান। সেখানে ধান কেটে মাড়াই ও শুকানোর পর স্তূপ করে রেখেছিলেন অনেক কৃষক। সেই ধানগুলোও তাঁরা তুলতে পারেননি। তার আগেই পানিতে সব তলিয়ে যায়। রাতে স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা সেখানে ছুটে যান। কিন্তু ঝড়বৃষ্টি হওয়ায় বাঁধ রক্ষায় কোনো কাজ করা সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

আজ মঙ্গলবার দুপুরে হাওর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, হাওর থেকে ধান কাটার চেয়ে সেখানে কাটা ও মাড়াই করে রাখা ধান তুলতে ব্যস্ত কৃষকেরা। থই থই পানির নিচ থেকে ধান তোলার চেষ্টা চলছে। তবে যাঁদের নৌকা নেই, তাঁরা যেন চরম অসহায়।

কৃষক সাজিদুর রহমান (৬২) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অবহেলার কারণে বাঁধটি ভেঙেছে। বাঁধে ১৫ দিন ধরে ছিদ্র। চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি ঢুকছে। পাউবো কর্মকর্তারা সেটি দেখে গেছেন। বারবার বলার পরও কোনো কাজ হয়নি। তিনি আরও বলেন, কোনো কিছুই হবে না। বাঁধে কোনো বস্তা, বাঁশ মজুত ছিল না। এখন বাঁধ ভাঙছে, আর সবকিছু আনা হচ্ছে। আহসানপুর গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম (৬০) জানান, গতকাল রাতে তারাবিহর নামাজের পর গ্রামে হইহুল্লোড় শুরু হয়। সবাই বাঁধে গিয়ে দেখেন, বাঁধ ভেঙে গেছে। কিন্তু কোনো সরঞ্জাম না থাকায় বাঁধ রক্ষার কোনো চেষ্টাই করতে পারেননি এলাকাবাসী।

আরও পড়ুন
ধান কেটে মাড়াই ও শুকানোর পর হাওরে স্তুপ করে রাখা হয়েছিল। বাঁধ ভেঙে এখন সেই ধান ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঢলের পানি। পানি থেকে নৌকা দিয়ে সেই ধান তোলার চেষ্টা করছেন কৃষকেরা। আজ দুপুরে হালির হাওরের আহসানপুর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

মহিবুর রহমান (৫০) হালির হাওর থেকে প্রতিবছর অন্তত ৭০০ মণ ধান পান। হাওরের খলায় শুকানো ৩৫০ মণ ধান ছিল তাঁর। সব পানিতে ভেসে গেছে। বাঁধের পাশে বসেই চোখ মুছছিলেন আরেক কৃষক আবদুল বাকিদ (৫২)। হাওরে তাঁর জমি ছিল ১২ একর। অর্ধেক ধানই তলিয়ে গেছে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে কথা বলার সময় নিজের নামটা লেখাতে অস্থির হয়ে ওঠেন সবুন নেছা (৫৫)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী-ছেলে কেউ নাই। একটা মেয়ে। হাওরে চার বিঘা জমির ধান ডুবছে। আমার সব গেছে। ঘরে খানি (খাবার) নাই। সরকারের খাতাত নামটা দেইন। আমি অসহায়।’

গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, যে বাঁধটি ভেঙেছে, সেটির প্রকল্প নম্বর ১৭। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভাপতি আহসানপুর গ্রামের মহিবুর রহমান। তিনি ‘নয়া আওয়ামী লীগার’ হিসেবে পরিচিত। কাজে চরম গাফিলতি করেছেন তিনি। এক সপ্তাহ ধরে বাঁধটি সংস্কারের দাবি জানানো হলেও কাউকে পাত্তা দেননি তিনি। বাঁধ ভাঙার পর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ নেই। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মহিবুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

গ্রামের কয়েক বাসিন্দা জানান, আহসানপুরের এই পানি যাবে উপজেলা সদরের সাচনা পর্যন্ত। হাওরে উপজেলার তিন ইউনিয়নের মানুষের জমি আছে। এখন পর্যন্ত মানুষ অর্ধেক ধান তুলতে পেরেছেন। তাঁরা যেগুলো কাটছেন, সেগুলো ব্রি-২৮। হাওরে ব্রি-২৯ ধানের আবাদ বেশি। সেই ধান মাত্র কাটা শুরু হয়েছিল।

বাঁধের পাশেই একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের ঘরে বসেছিলেন পাউবোর সিলেট বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী, সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম, জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিশ্বজিত দেব।

হালির হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে কৃষকের সোনার ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। বাঁধে ১৫ দিন ধরে ছিদ্র দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি ঢুকছিল। কৃষকদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি
ছবি: প্রথম আলো

প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা রাত থেকেই সেখানে আছেন। জিও ব্যাগসহ অন্যান্য সরঞ্জাম আনা হচ্ছে। সরঞ্জাম এলে পানি আটকানোর কাজ শুরু করা হবে। এখন বাঁধ দিয়ে কী লাভ হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাওরটি বেশ বড়। উপজেলা সদরের কাছাকাছি পানি যেতে এক-দুদিন সময় নেবে। তাই পানি আটকাতে পারলে কিছু ফসল রক্ষা পাবে।

ইউএনও বিশ্বজিত দেব বলেন, বাঁধগুলোর গোড়ায় ২০-২৫ দিন ধরে পানির চাপ। এমনিতেই মাটি নরম হয়ে আছে। অনেক বাঁধই দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেক বাঁধে ছিদ্র আছে। তাঁরা একদিকে কাজ করেন, অন্যদিকে ভেঙে যায়। এখানেও তা-ই হয়েছে। তিনি জানান, হালির হাওরের বাঁধ ভাঙায় ৫০০ হেক্টর জমির ধানের ক্ষতি হবে।