১০ বছরের হাসনাইনকে কেন কাজে পাঠালেন, আক্ষেপ বাবা–মায়ের

নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত শিশু হাসনাইনের শোকার্ত বাবা–মা। শনিবার ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আবদুল্লাহ ইউনিয়নের মিনাবাজারে তাঁদের বাড়িতে
প্রথম আলো

২০১০ সালের ১১ মার্চ মো. হাসনাইনের জন্ম। সেই হিসাবে তার বয়স হয়েছিল ১১ বছর ৪ মাস। এই বয়স যেকোনো শিশুর খেলার বয়স। অথচ বাবার অসুস্থতার কারণে চলতি বছরের শুরুতে হাসনাইনকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কারখানায় কাজে পাঠায় পরিবারটি। ৮ জুলাই উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৫২ জনের একজন শিশু হাসনাইন।

ভোলার চরফ্যাশনে তার বাড়িতে চলছে মাতম। কেন হাসনাইনকে কাজে পাঠালেন, এ আক্ষেপেই মা নাজমা বেগম (৩৫) বুক চাপড়ে বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়ছেন। তিনি ছেলের লাশটি চান, তাকে কবর দিতে চান নিজের বাড়িতে।

ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত সাতজন ভোলার চরফ্যাশনের। এ ঘটনায় উপজেলার আরও ৭ জন আহত হয়েছেন। আজ শনিবার সরেজমিন কথা হয় স্বজনহারা পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের সঙ্গে। আবদুল্লাহ ইউনিয়নের মিনাবাজার এলাকায় হাসনাইনের বাড়িতে দেখা যায়, হাসনাইনের মা বারবার বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছেন পাগলের মতো। বড় বোন সাথীও পাগলের মতো কান্না করছেন। কেন কাজে পাঠালেন, এ কথা বলে বিলাপ করছিলেন তাঁরা। হাসনাইনের চাচাতো ভাই মো. রাকিবও (২২) আগুনে পুড়ে নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁর বাবার নাম মো. কবির।

মা নাজমা বেগম (৩৫) বুক চাপড়ে বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়ছেন। তিনি ছেলের লাশটি চান, তাকে কবর দিতে চান নিজের বাড়িতে।

শিশুসন্তান হাসনাইনের আয় দিয়েই বাবা ফজলুর রহমানের চিকিৎসা হচ্ছিল। বাবা ফজলুর রহমানের ইচ্ছা ছিল, একমাত্র ছেলেকে পড়ালেখা করাবেন। কিন্তু নিজের অসুখের কারণে একমাত্র ছেলেকে শ্রমিকসরদার মোতালেবের কাছে নারায়ণগঞ্জে পাঠাতে বাধ্য হন। করোনা পরিস্থিতির আগে হাসনাইন স্থানীয় মোজাম্মেল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। করোনা মহামারির কারণে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর বিদ্যালয়ে যায়নি কখনো। এ বছর তাঁর পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার কথা। ইচ্ছা ছিল বিদ্যালয় খুললেই আবার পড়াশোনা শুরু করবে সে। বাবা এসব কথা বলেও কাঁদছেন।

ফজলুর রহমান বলেন, তিনি সুস্থ থাকতে খেতে শ্রমিকের কাজ করতেন। বছরখানেক আগে তাঁর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়া রোগ দেখা দেয়। এখন অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারছেন না। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মৃত্যুর আগে তাঁর একান্ত ইচ্ছা, ছেলের জানাজায় অংশ নেবেন। আর ছেলেকে নিজ বাড়িতে করব দেবেন। কিন্তু লাশ চেনা যাচ্ছে না বলে এখনো ছেলের মরদেহের খুঁজ পাননি।

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ১৮ জন শ্রমিক কারখানার চারতলায় কাজ করছিলেন। এ সময় কারখানার ছাদে উঠে ১১ জন প্রাণ বাঁচাতে পারলেও সাতজন নিচে নেমে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন।

চরফ্যাশন উপজেলার আওয়াজপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা শ্রমিকসরদার মো. মোতালেব হোসেন বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ১৮ জন শ্রমিক কারখানার চারতলায় কাজ করছিলেন। এ সময় কারখানার ছাদে উঠে ১১ জন প্রাণ বাঁচাতে পারলেও সাতজন নিচে নেমে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন।

ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ আবদুল মান্নান মাতব্বরের একমাত্র ছেলে নোমান (২২) চার বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় মাসিক ১৩ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। ছেলের মাসে মাসে পাঠানো টাকায় তাঁর ওষুধ কেনা ও সংসারের খরচ চলত। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এখন নির্বাক হয়ে গেছেন তিনি। কেউ গেলে শুধু তাঁর দিকেই চেয়ে থাকেন। মৃত ছেলের মুখটি একটিবারের জন্য দেখতে চান এই বৃদ্ধ। নোমানের মা ফিরোজা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তাঁদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। এর আগেও তাঁদের তিনটি ছেলে বড় হয়ে মারা গেছে। সর্বশেষ অন্ধের যষ্টি এই একটি ছেলেকে অনেক কষ্ট করে লালনপালন করে বড় করেছেন। আশা ছিল শেষ বয়সে এই ছেলেই তাঁদের দেখভাল করবেন, কিন্তু তা নেই তাঁদের কপালে।

অগ্নিকাণ্ডে চরফ্যাশন উপজেলার অন্য নিহত ব্যক্তিরা হলেন আবদুল্লাহ ও জিন্নাগড় ইউনিয়নের মাঝামাঝি দাসকান্দি এলাকার আবু তাহেরের মেয়ের জামাই মো. শাকিল (২৩), চরমাদ্রাজ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের তাজউদ্দিনের ছেলে মো. রাকিব (১৮), দক্ষিণ আইচা চরমানিকা ইউনিয়নের মো. ফখরুল ইসলামের ছেলে শামিম (১৯) এবং আছলামপুর ইউনিয়নের জনতা বাজার এলাকার মো. গোলাম হোসেনের ছেলে মো. মহিউদ্দিন (১৮)। অগ্নিকাণ্ডে আওয়াজপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কামাল রাঢ়ীর ছেলে মো. ফয়সাল (১৬), মো. রুহুল আমিন পাটওয়ারীর ছেলে মো. রাসেল (১৮), আবদুল গনির ছেলে মো. ইউছুফ (১৭), মো. লিটনের ছেলে মো. আল আমিন (১৭), আবু জাহেরের ছেলে মো. মোতালেবসহ (২৪) ৭ জন আহত হয়েছেন।

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রুহুল আমিন বলেন, নিহতদের লাশ শনাক্তের জন্য তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে। এ জন্য নিহতদের বাবা-মাকে ঢাকায় পাঠানো দরকার। কিন্তু অনেক মা–বাবা যেতে চাইছেন না।