১৪ আসামি জামিনে, মালিকের জিম্মায় কার্গো, জানেন না বাদী

লঞ্চ থেকে লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। স্বজন ও স্থানীয় লোকজন অপেক্ষা করছেন শীতলক্ষ্যার তীরে। ৫ এপ্রিল ২০২১ছবি: দীপু মালাকার

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে লঞ্চ ডুবে ৩৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৪ আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বন্ডে মালিকের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে অভিযুক্ত এসকেএল-৩ নামের জাহাজটি। বৃহস্পতি ও রোববার পৃথক দুটি আদালত আসামিদের জামিন ও জাহাজটিকে মালিকের জিম্মায় দেওয়ার আদেশ দেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন ও আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, গত বুধবার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আসামিদের জামিন আবেদন করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতে জানান, অভিযুক্ত জাহাজমালিকপক্ষ লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহত ৩০ জনের পরিবারকে জনপ্রতি ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। বাকি ৪ জনের পরিবারের লোকজন ক্ষতিপূরণ নিতে রাজি হননি। তবে সবাই এ ঘটনায় কারও প্রতি কোনো অভিযোগ নেই বলে লিখিত দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার আদালত আসামিদের জামিন আদেশ দেন।

আরও পড়ুন

পুলিশ পরিদর্শক আসাদুজ্জামান বলেন, গতকাল রোববার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ূন কবিরের আদালত ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বন্ডে জাহাজটিকে মালিকের জিম্মায় দেওয়ার আদেশ দেন।

তবে মামলার বাদী বিআইডব্লিউটিএর ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক বাবু লাল বৈদ্য আসামিদের জামিন ও জাহাজ জিম্মায় দেওয়ার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। বাবু লাল বৈদ্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোমবার সকালে বন্দরঘাট থেকে জাহাজটি নিয়ে যাওয়ার পর বিষয়টি আমি জানতে পেরেছি। জাহাজের জিম্মা কিংবা ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে কিছুই জানি না।’

ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমএল সাবিত আল হাসান উদ্ধারের পর
ফাইল ছবি

এদিকে আসামিদের জামিন ও জাহাজটি মালিকের জিম্মায় চলে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ডুবে যাওয়া লঞ্চের কেরানি মঞ্জুরুল ইসলাম। ঘটনার দিন ওই লঞ্চেই ছিলেন তিনি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সদর-বন্দর-নৌ থানায় ঘুরছি। কেউ মামলা নেয় নাই। সর্বশেষ মেরিন কোর্টে মামলা করতে গেলাম। আবেদন রাখা হইছিল। এখনো মামলা হয় নাই।’

এমন ঘটনা নদীপথকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ জেলা লঞ্চমালিক সমিতির সভাপতি বদিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের মামলা নেওয়া হয়নি। তখনই বুঝেছিলাম, বিআইডব্লিউটিএর করা মামলা চোখে ধুলো দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাদের যোগসাজশেই আসামিদের জামিন হয়েছে। এই ঘটনা নদীতে কার্গো ও বাল্কহেডচালকদের আরও বেপরোয়া করে তুলবে এবং আরও লঞ্চডুবির জন্য সহায়ক হবে।’

ঘটনার দুই মাস না পেরোতেই এত বড় ঘটনায় অভিযুক্তদের জামিন ও কার্গো জাহাজকে জিম্মায় দেওয়াকে একটি বাজে উদাহরণ হিসেবে মন্তব্য করেন মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, বাদীপক্ষ জানে না, ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চমালিকপক্ষও জানে না, অথচ আসামিরা জামিন পেলেন। জাহাজটিও মালিকের জিম্মায় চলে গেল। এটা পুরোপুরি রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতা। বিআইডব্লিউটিএর এমন দায়িত্বহীনতা ভিন্ন কিছু ইঙ্গিত করে।

নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে রং বদলে ফেলা কার্গো জাহাজ এসকেএল-৩
প্রথম আলো

লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহত দুই বোন সাদিয়া আক্তার (১১) ও লতা আক্তারের (১৯) বাবা কলা বিক্রেতা দুখু মিয়া প্রথম আলোকে বলেছেন, অভিযোগ নেই মর্মে তিনি কোনো কাগজে স্বাক্ষর করেননি। একজন অপরিচিত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে তাঁকে নারায়ণগঞ্জে ডেকে এনে জনপ্রতি ১ লাখ টাকা দেন এবং ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন স্বীকারোক্তি হিসেবে একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে বলেন। সাক্ষরজ্ঞান না থাকায় তিনি টিপসই দিয়ে সেখান থেকে চলে যান। তবে তাতে কী লেখা ছিল, সে বিষয়ে কিছু জানেন না তিনি। একই কথা বলেছেন আরেক স্বজন মো. মিঠু।

গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জগামী এমএল সাবিত আল হাসান লঞ্চটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয় এসকেএল-৩ (রেজিস্ট্রেশন নম্বর: ০১-২৬৪৩) নামের একটি কার্গো জাহাজ। এ ঘটনায় ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। বাগেরহাট-২ আসনের সাংসদ শেখ সারহান নাসের তন্ময়ের মালিকানাধীন জাহাজটি চলাচলের অনুমতি ছাড়াই চলছিল বলে এ ঘটনায় গঠিত নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি জানিয়েছিল। অনুমোদনহীন জাহাজটির বেপরোয়া গতি ও সংকীর্ণ নৌপথকে লঞ্চডুবির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিল তদন্ত কমিটি।

আরও পড়ুন

এত বড় প্রাণহানির ঘটনায় টানা এক সপ্তাহ চেষ্টার পরেও লঞ্চমালিকপক্ষ নারায়ণগঞ্জের কোনো থানায় মামলা করতে পারেনি। পরবর্তীকালে মেরিন আদালতও তাঁদের মামলা নেয়নি বলে লঞ্চের মালিক প্রথম আলোকে অভিযোগ করেছিলেন। পরে বিআইডব্লিউটিএর ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক বাবু লাল বৈদ্য অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে বন্দর থানায় একটি মামলা করেন। মামলার পর ৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে ১৪ জন স্টাফসহ জাহাজটিকে আটক করে কোস্টগার্ড। পরে বাবু লাল বৈদ্যের করা মামলায় জাহাজটিকে জব্দ এবং স্টাফদের গ্রেপ্তার দেখায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ থানা-পুলিশ।