নদী-জলাভূমিসংলগ্ন জমিতে কারখানা করতে অনুমতি লাগবে

শিল্পকারখানা করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে নদী দখল হতে পারে
ফাইল ছবি

পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সারা দেশের যাতায়াত সহজ হয়েছে। খরচ কমেছে পণ্য পরিবহনে। এই সেতু ঘিরে শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা। তবে অতীত অভিজ্ঞতার কারণে শিল্পায়নের কারণে নদী দখল ও দূষণের আশঙ্কা করছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

প্রমত্ত পদ্মা নদীর ওপর সেতুর অভাবে এত বছর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভারী শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। স্থানীয় লোকজন আশা করছেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। আর উদ্বেগের বিষয়টি এখানেই।

নদী রক্ষা কমিশন মনে করছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন শিল্পকারখানা করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে নদী ও জলাভূমি দখল হতে পারে। দখল ও শিল্পবর্জ্যের কারণে নদীদূষণের মাত্রা বাড়তে পারে।

নদী কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, নদীর প্রবাহ নষ্ট করে, নদীর জায়গা দখল করে, নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে শিল্পকারখানা করা যাবে না। কমিশন বলছে, নদীর জায়গা দখল করে আগে অনেক জায়গায় কারখানা গড়ে উঠেছে। যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। তবে এবার তারা কঠোর হবে। নতুন কাউকে নদীর জায়গায় কারখানা করতে দেওয়া হবে না।

পদ্মা সেতু ঘিরে শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দারা
ফাইল ছবি

তাই দক্ষিণাঞ্চলে নতুন শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার আগে শিল্পমালিকদের একটি বার্তা দিতে চায় কমিশন। এরই অংশ হিসেবে সংস্থাটি ২১ জেলা প্রশাসককে (ডিসি) চিঠি দিয়েছে। গত ২৭ জুন ডিসিদের পাঠানো এ চিঠিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার নদী ও জলাভূমিসংলগ্ন জমিতে যেকোনো ধরনের প্রকল্প গ্রহণের আগে অবশ্যই কমিশনের অনাপত্তি নিতে হবে।

আরও পড়ুন

শিল্পায়নের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়

সারা দেশে নদী ও জলাভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে। শিল্পকারখানার বর্জ্যে নদীর দূষণ বাড়ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ১৯৬০-এর দশকে দেশে নদী ছিল ৪৪৫টি। এখন দেশে নদী রয়েছে ২৩১টি। নৌপথ কমে প্রায় চার হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে। বর্ষা মৌসুমে নৌপথ অবশ্য ছয় হাজার কিলোমিটার থাকে।

নদী বাঁচানো ও নদীর পরিসর বাড়ানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ২০১৪ সালে গঠিত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে হাইকোর্ট নদীর অভিভাবকের দায়িত্ব দেন। কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকরে সব ব্যবস্থা নিতে সরকারকে বলেন।

নদী রক্ষা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সরকার নির্ধারিত নদীর জায়গায় কেউ শিল্পকারখানা করতে পারবে না। নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ করে কারখানা করা যাবে না। কেউ যদি তার নিজ জমিতে কারখানা করতে চায়, অবশ্যই পরিবেশবান্ধব কারখানা করতে হবে। নদীতে যাতে বর্জ্য না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

কর্মকর্তারা বলেন, ডিসিদের বার্তা দেওয়া হয়েছে, কেউ যদি লাল ক্যাটাগরির কারখানা করতে চায়, অবশ্যই অনাপত্তি নিতে হবে। তা ছাড়া হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী, নদী, খাল–বিল, জলাশয়ের ক্ষেত্রে নতুন প্রকল্প গ্রহণের আগে নদী রক্ষা কমিশনের অনাপত্তি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

আরও পড়ুন

চিঠিতে হাইকোর্টের আদেশের উল্লেখ

ডিসিদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় শিল্পায়ন যাতে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই হয়, নদ-নদী, খাল–বিল ও জলাশয় যাতে দখল, দূষণ ও ভরাটমুক্ত রাখা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

সারা দেশে নদী ও জলাভূমিগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে
ফাইল ছবি

চিঠিতে হাইকোর্টের ২০১৯ সালের একটি আদেশের কথাও উল্লেখ করা হয়, যাতে বলা হয়েছে, দেশের সব নদ-নদী, খাল–বিল, জলাশয়ের আশপাশে নতুন প্রকল্প গ্রহণে সরকারের সব সংস্থা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে জানাবে। একই সঙ্গে কমিশন থেকে অনাপত্তি নিতে হবে।

আরও পড়ুন

এখনই কঠোর হতে হবে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী রক্ষা করতে চাইলে এখনই কঠোর হতে হবে। ভূমির ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। শিল্পায়ন হতে হবে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব।

নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সরদার করে রাখা হয়েছে। তারা সুপারিশ, অনুরোধ আর চিঠি দেওয়া ছাড়া কিছু করতে পারে না। অথচ প্রতিষ্ঠানটি নদীর অভিভাবক।

ইকবাল হাবীব বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে পদ্মা সেতুর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই ভূমির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কৃষিজমি বাঁচাতে হবে। নদীর জমি রক্ষা করতে হবে। পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তুলতে হবে। না হলে দক্ষিণাঞ্চলও একদিন গাজীপুর, ময়মনসিংহের মতো ধ্বংস হবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এখন দক্ষিণাঞ্চলে নানা শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। তবে আমাদের বার্তা হচ্ছে, নদীর ক্ষতি করে, নদী দূষণ করে কোনো শিল্প করা যাবে না।’