বাংলা ভাষার অন্যতম কবি আবুল হাসান ছিলেন বিচ্ছিন্নতা ও ব্যথার অনুভবে অনন্য একজন। আবুল হাসানের ব্যক্তিত্বই আকর্ষণ করত অন্যদের। এরই দৃষ্টান্ত জার্মান শিল্পীর সঙ্গে কবির বন্ধুত্বের ইতিহাস। আর সেসব গল্পই উঠে এসেছে ‘বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আলোচকদের বক্তব্যে উঠে এল এসব কথা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে আজ শনিবার অনুষ্ঠিত হলো ‘বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ৭৭ পৃষ্ঠার এই বইয়ের স্মৃতি আর চিঠিপত্র পর্বে আছে আবুল হাসানকে নিয়ে লেখা জার্মান শিল্পী রাইনহার্ট হেভিকের স্মৃতিচারণা। আছে রাইনহার্ট হেভিকেকে লেখা আবুল হাসানের চিঠি। ১৯৭৪ সালে কবি আবুল হাসান হৃদ্যন্ত্রের জটিলতার চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব জার্মানির বার্লিনে। তখন সখ্য হয় দুই সৃজনশীল ব্যক্তির। সে ঘটনার সূত্র ধরেই তাঁদের লেখা চিঠিপত্র ও স্মৃতিচারণা নিয়ে প্রকাশিত হলো এ গ্রন্থ।
প্রকাশনা উৎসবে কবি ও প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, জার্মান শিল্পী রাইনহার্ট হেভিকের সঙ্গে কবি আবুল হাসানের বন্ধুত্ব সৃজনশীল দুই মানুষের আত্মার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার একটি দৃষ্টান্ত। আবুল হাসান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন আশির দশকে এই কবির লেখায় তরুণদের মগ্নতার কথা। সাজ্জাদ শরিফ বলেন, সত্তরের দশকে স্বাধীনতার পর আশ্চর্য রকম ব্যতিক্রম ছিল আবুল হাসানের কবিতা। তিনি ছিলেন বহুপ্রজ। রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন বটে, তবু তাঁর লেখা অধিকাংশ কবিতায় ছিল একক ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা ও ব্যথার অনুভব। ছিল সেই সময় লেখা অন্য কবিদের কবিতা থেকে পৃথক কণ্ঠস্বর ‘নিজের দিকে ফিরে তাকানো’র অনুভব। সে ভাষা ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল পরবর্তী প্রজন্মকে। জার্মান শিল্পী রাইনহার্টের কাছ থেকে বইয়ের মূল পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য তিনি ধন্যবাদ জানান শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানকে।
‘বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব’ গ্রন্থের সম্পাদক ওয়াকিলুর রহমান গ্রন্থে স্থান পাওয়া চিঠি, পুলিশের নথিসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি জানান, ১৯৮৮ সালে জার্মানির বার্লিনে বসবাসের সময় থেকে তিনি সেখানে কবি আবুল হাসানের স্মৃতি খুঁজেছিলেন। ২০০৯ সালে রাইন হার্ট হঠাৎ ফোন করে বলেন, তাঁর কাছে আবুল হাসানের কবিতা, চিঠি আছে। সেসব জার্মান ভাষায় অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল এই বই প্রকাশের স্বপ্ন। এরপর প্রকাশের বিভিন্ন পর্বের অভিজ্ঞতা উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে। তিনি জানান, আবুল হাসানের পরিবারের কাছে কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি, অথচ একজন জার্মান শিল্পী ঠিকই গুছিয়ে রেখেছিলেন এত দিন আগের স্মৃতি।
আবুল হাসানের সঙ্গে বহু স্মৃতি জমা আছে কবি, সাংবাদিক হাসান হাফিজের। তিনি বললেন, আবুল হাসানের ব্যক্তিত্বই সবাইকে আকর্ষণ করত। মনে হতো যুগযুগান্তরের আপনজন। হাসান হাফিজের স্মৃতিকথায় উঠে এল এক তরুণের এই শহরে কবি আবুল হাসান হয়ে ওঠার ইতিহাস। তাঁরা দুজনই একসঙ্গে তখন থাকতেন ঢাকা কলেজের সাউথ হোস্টেলে। হাসান হাফিজ বললেন, কবি নির্মলেন্দু গুণ আর আবুল হাসানের সেই সময়ের অচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের কথা। আবুল হাসানের অকালপ্রয়াণের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, সেই সময়ের কবিতার ভূগোল আবিষ্কার করতে হলে আবুল হাসানকে পুনঃ আবিষ্কার করতে হবে।
আবুল হাসানকে নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাসের নাম ‘ঝিনুক নীরবে সহো’। উপন্যাসের লেখক মোশতাক আহমেদ বলেন, কোন মুগ্ধতায় আবুল হাসানকে নিয়ে এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি কাজ করেছেন, সে অনুভবের কথা।
আবুল হাসানের ‘নিঃসঙ্গতা’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান কবি ও সাংবাদিক আলতাফ শাহনেওয়াজ। ‘চামেলি হাতে নিম্ন মানের মানুষ’ কবিতা আবৃত্তি করেন কবি আফরোজা সোমা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অনুবাদক ও প্রথমা প্রকাশনের জাভেদ হুসেন। সবশেষে প্রথমা প্রকাশনের মেরিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘একজন কবি আবুল হাসানের টানে সবাই উপস্থিত হয়েছেন, এটাই এ বই প্রকাশের সার্থকতা।’ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কবি জাহিদ হায়দার, শিল্পী ঢালী আল মামুন, দিলারা বেগম জলি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক, শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন, কথাশিল্পী পারভেজ হুসেন, আফসানা বেগম, সাখাওয়াত টিপু, আলফ্রেড খোকন ও স্থপতি সালাউদ্দিন আহমেদ।
‘বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব’ গ্রন্থের পরিশিষ্টতে পাওয়া যাবে শিল্পীকে নিয়ে লেখা আবুল হাসানের কবিতা। আছে তাঁদের দুজনকে নিয়ে দেওয়া পুলিশের গোপন প্রতিবেদন, নথিপত্রের প্রতিলিপি। অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক ও অনুবাদক আব্দুল্লাহ আল–ফারুক এবং গবেষক, শিক্ষক ও অনুবাদক রেজাউল করিম সুমন।