ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে সরকার ‘নিরুপায়’, কিন্তু কেন
সড়কের অবৈধ ও মেয়াদোত্তীর্ণ—কোনো যানবাহনই উচ্ছেদ করতে পারছে না সরকার।
এ কাজ করতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে চেষ্টা চালিয়েছে। তবে তারাও এগোতে পারেনি। ফলে এসব যান সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়াচ্ছে।
সরকারি ভাষ্যমতে, নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ। একই সঙ্গে ২০ বছরের পুরোনো ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান, ২৫ বছরের পুরোনো বাস-মিনিবাসও অবৈধ। এই দুই ধরনের যানবাহনই সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, দেশে বৈধ যানবাহন আছে প্রায় সাড়ে ৬৪ লাখ। বৈধ যানের ২ শতাংশের কম বাস-মিনিবাসসহ গণপরিবহন। এর প্রায় ৪৬ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ বা লক্কড়ঝক্কড়। আর সরকারের বিবেচনায় ‘অবৈধ’ তিন চাকার যানবাহন আছে প্রায় ৭০ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের স্বল্পতা আছে। আবার যা আছে, তা–ও জরাজীর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে কারিগরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ তিন চাকার ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশায় ঢাকাসহ সারা দেশ ছেয়ে গেছে। এসব যান বাড়তে দিয়ে এখন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর ত্রুটিপূর্ণ এই যানগুলো দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে। বাড়ছে প্রাণহানি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে দেশে বৈধ যানবাহন আছে প্রায় সাড়ে ৬৪ লাখ। বৈধ যানের ২ শতাংশের কম বাস-মিনিবাসসহ গণপরিবহন। এর প্রায় ৪৬ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ বা লক্কড়ঝক্কড়। আর সরকারের বিবেচনায় তিন চাকার ‘অবৈধ’ যানবাহন আছে প্রায় ৭০ লাখ।
দুর্ঘটনা-প্রাণহানি বাড়াচ্ছে
বিআরটিএর তথ্য অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ হাজার ৭৪১ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিন চাকার ছোট যানের আরোহী ছিলেন ৭৮৬ জন। অর্থাৎ প্রায় ২১ শতাংশ। এই তিন চাকার যানের মধ্যে নছিমন, করিমন, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক আছে। সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি—৩২ শতাংশ ছিলেন মোটরসাইকেলের আরোহী।
বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২৪ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ২৯৪ জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ২ হাজার ৬০৯ জন। যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নিহত ১ হাজার ৭২৩ জন ছিলেন তিন চাকার যানবাহনের যাত্রী। যা মোট নিহতের ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ।
বিআরটিএ ও পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, তিন চাকার অবৈধ যানবাহন উচ্ছেদে বরাবরই সোচ্চার বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। নানা বিষয়ে তাঁদের যত আন্দোলন হয়, তাতে তিন চাকার যানবাহন বন্ধের দাবি থাকে। সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকেও তাঁরা এসব যান বন্ধে কড়া অবস্থান নেন। কিন্তু লক্কড়ঝক্কড় বাস-ট্রাক উচ্ছেদের প্রশ্ন এলে তাঁরা সহযোগিতা করেন না। বরং ধর্মঘট ডেকে উচ্ছেদ অভিযান আটকে দেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে পুরোনো বাস-ট্রাক উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘটের ডাক দেন। পরে সরকার কিছুটা পিছু হটে।
বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, তিন চাকার ছোট যানসহ ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন শহর-গ্রামের সর্বত্র বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান যুক্ত। তবে এসব যানের সংখ্যাধিক্য ও কারিগরি ত্রুটি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এসব যানের কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে; কিন্তু এখনো তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রতিটি সভায় মহাসড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কে তিন চাকার যানবাহন চলতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে আসছে; কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
অভিযান বন্ধ হয়নি। বেশি পুরোনো বাস-ট্রাক আগে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কম পুরোনোগুলো পর্যায়ক্রমে ধরা হবে। এ ছাড়া যেসব পুরোনো বাস উচ্ছেদ করা হবে, সেগুলোর পরিবর্তে নতুন যানবাহন নামানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য পরিবহনমালিকদের সহজ শর্তে ঋণ ও আমদানিনীতি সংশোধনের বিষয়ে কাজ চলছে।
পুরোনো বাস-ট্রাক সরানো যাচ্ছে না
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও সড়ক দুর্ঘটনা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে—এই বিবেচনায় লক্কড়ঝক্কড় বাস রাস্তা থেকে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের শেষ দিকে দুই দফা বৈঠক করে লক্কড়ঝক্কড় বাস সড়ক থেকে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য পরিবহনমালিকদের ছয় মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
গত মে মাসে সেই সময়সীমা শেষ হয়। কিন্তু পরিবহনমালিকেরা নিজে থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-ট্রাক উঠিয়ে নেননি।
সময়সীমা পেরোনোর প্রায় দুই মাস পর গত ২০ জুলাই থেকে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান শুরু হয়। এর মধ্যে গত ২৮ জুলাই পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা এই অভিযান বন্ধের দাবিতে ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। পরে অবশ্য সরকারের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার শর্তে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, ২০ থেকে ৩১ জুলাই অভিযান চালিয়ে মাত্র ৫১টি পুরোনো বাস-ট্রাক জব্দ করে সংস্থাটি। মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-ট্রাক রাতে চলাচল করে বেশি। এ জন্য রাতেও অভিযান চালানোর পরিকল্পনা ছিল; কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘটের ঘোষণার পর অভিযান একরকম বন্ধ হয়ে যায়। যদিও ঘোষণা দিয়ে অভিযান বন্ধ করা হয়নি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০২৩ সালের ১৭ মে বাস-মিনিবাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০ বছর। আর ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানসহ মালবাহী যানের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৫ বছর।
তবে তৎকালীন সরকার সড়ক থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-ট্রাক উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে পিছু হটে। তখন এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়।
বিআরটিএ ও পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, তিন চাকার অবৈধ যানবাহন উচ্ছেদে বরাবরই সোচ্চার বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। নানা বিষয়ে তাঁদের যত আন্দোলন হয়, তাতে তিন চাকার যানবাহন বন্ধের দাবি থাকে। সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকেও তাঁরা এসব যান বন্ধে কড়া অবস্থান নেন; কিন্তু পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস-ট্রাক উচ্ছেদের প্রশ্ন এলে তাঁরা সহযোগিতা করেন না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৬ জুন পুরোনো যানবাহনের বয়সসীমার আগের প্রজ্ঞাপনটি বহাল করে। পাশাপাশি এসব যান সড়ক থেকে উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহছানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অভিযান বন্ধ হয়নি। বেশি পুরোনো বাস-ট্রাক আগে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কম পুরোনোগুলো পর্যায়ক্রমে ধরা হবে। এ ছাড়া যেসব পুরোনো বাস উচ্ছেদ করা হবে, সেগুলোর পরিবর্তে নতুন যানবাহন নামানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য পরিবহনমালিকদের সহজ শর্তে ঋণ ও আমদানি নীতি সংশোধনের বিষয়ে কাজ চলছে।
১০ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নেতৃত্বে সচিবালয়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে পুরোনো বাসের জায়গায় নতুন বাস নামাতে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত-বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সহজ শর্তে ঋণের বিষয়ে তাঁরা চূড়ান্ত আশ্বাস না দিলেও বিবেচনায় নেওয়ার কথা জানান বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে।
বর্তমানে পাঁচ বছরের পুরোনো বাস আমদানি করা যায়। পরিবহনমালিকদের দাবি তা ১২ বছর করা। সরকার সাত বছর করার বিষয়ে চিন্তা করছে বলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। এই বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিক আলোচনা হয়েছে। এমনকি নতুন ও পুরোনো বাস আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক সংশোধনের বিষয়টিও সরকারের বিবেচনাধীন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো বাস-ট্রাক উচ্ছেদে তাঁদের কোনো আপত্তি নেই। তবে হুট করে উচ্ছেদ করলে শূন্যতা তৈরি হবে, ভোগান্তি বাড়বে। তাই নতুন বাস আমদানিতে সরকারের সহজ শর্তে ঋণসহায়তা চাইছেন তাঁরা। ঋণ পেলে পুরোনো বাস আর থাকবে না।
নানা ত্রুটিযুক্ত বিপুলসংখ্যক এসব যানের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এই যানবাহনগুলো যেভাবে ছড়িয়েছে, এর সঙ্গে যত সংখ্যক মানুষ যুক্ত রয়েছেন, তা হুট করে বন্ধ করা যাবে না।
অবৈধ যানের দাপট
বিআরটিএ ২০ ধরনের যানবাহনের নিবন্ধন দেয়। গত জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬৪ লাখ। অন্যদিকে নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরে প্রায় ৭০ লাখ তিন চাকার ছোট যানবাহন চলাচল করে। এগুলোকে সরকার অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করে। এসব যানের মধ্যে রয়েছে নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি, ইজিবাইক ও পাখি। সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত রিকশা।
বিভিন্ন ধরনের তিন চাকার অবৈধ যানবাহনের প্রকৃত হিসাব সরকারের কোনো দপ্তরে নেই। বিআরটিএ, যাত্রী অধিকার সংগঠন, পুলিশ ও অন্যান্য অংশীজনের অনুমিত হিসাবমতে, ব্যাটারি-যন্ত্রচালিত তিন চাকার অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে আছে প্রায় ৫০ লাখ। আর ঢাকায় আছে ২০ লাখের মতো।
তিন চাকার এই যানবাহনগুলোর কাঠামোগত ও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নানা ত্রুটিযুক্ত বিপুলসংখ্যক এসব যানের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এই যানবাহনগুলো যেভাবে ছড়িয়েছে, এর সঙ্গে যত সংখ্যক মানুষ যুক্ত রয়েছেন, তা হুট করে বন্ধ করা যাবে না।
অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামানের সুপারিশ হলো এই যানকে নীতিমালার আওতায় এনে কারিগরিভাবে উন্নয়ন করা যেতে পারে। কোন কোন সড়কে, কতসংখ্যক এই যান চলতে দেওয়া হবে, তার একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকা দরকার।