দাবদাহ এলাকার হাসপাতালে ধারণক্ষমতার বেশি রোগী

প্রচণ্ড গরমে বিভিন্ন রোগে অনেক শিশু আক্রান্ত হচ্ছে। গতকাল রাজধানীর শিশু হাসপাতালের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডেছবি: সাজিদ হোসেন

প্রচণ্ড গরমে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। দেশের যেসব জেলায় এই দাবদাহ প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে, সেখানকার হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে রোগী বেশি। এদিকে রাজধানীবাসীও তাপের প্রখরতা টের পাচ্ছেন। তবে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগী বাড়লেও সহনীয় পর্যায়ে আছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ঈদ ও বৈশাখের ছুটি কাটিয়ে এখনো সবাই ঢাকায় ফেরেননি, তাই রোগীও কম।

গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে, ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই দুই জেলায় বেশ কিছুদিন ধরেই তাপপ্রবাহ বেশি।

আরও পড়ুন

বিশেষ করে চার দিন ধরে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহী, পাবনা, বরিশালেও প্রচণ্ড গরম। গতকাল শনিবার রাজধানী ঢাকায় আগের দিনের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে। রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গতকাল ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রথম আলোর যশোর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, পাবনা ও বরিশালের প্রতিবেদকেরা সেসব জেলার হাসপাতালের চিত্র জানিয়েছেন। এতে দেখা যায়, ঢাকার বাইরে যেসব অঞ্চলে প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে, সেখানে রোগীও বেশি।

ঢাকার বাইরে শয্যার চেয়ে রোগী বেশি

গতকাল যশোর জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে পা ফেলার জায়গা ছিল না। ওয়ার্ডের মেঝে, বারান্দা—সব জায়গায় রোগী। গত শুক্রবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়া নিয়ে ৫ শিশুসহ ১৭ জন ভর্তি হয়েছেন। অন্য সময়ে এখানে গড়ে ১০ জন ভর্তি থাকেন। শিশু ওয়ার্ডে ২৪টি শয্যার বিপরীতে ৫৬ শিশু ভর্তি আছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ বলেন, ২৭৮ শয্যার হাসপাতালে গতকাল ৭০৩ জন রোগী ভর্তি ছিলেন, যা এযাবৎকালে সর্বোচ্চ।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা উম্মে ফারহানা প্রথম আলোকে জানান, ১০০ শয্যার হাসপাতালে বেশ কিছুদিন ধরেই ৩০০-এর কাছাকাছি রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে আসছেন। তবে শুক্রবার তা আরও বেড়েছে। জেলার ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালে শুক্রবার ৩৬১ জন ভর্তি ছিলেন। গতকাল দুপুরে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৬৬ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন, ৫৪ জনই শিশু। আর ১৩ শয্যার শিশু ওয়ার্ডে ৫৬ শিশুকে চিকিৎসাধীন পাওয়া যায়।

আলমডাঙ্গা উপজেলার বড়গাংনী গ্রামের বাসিন্দা ১০ মাস বয়সী নাতি সাওদাকে নিয়ে দাদি বুলবুলি খাতুনের নাজেহাল অবস্থা। বুলবুলি বলেন, ‘শুক্কুরবার বাড়িতি হঠাৎ করে বুমি আর পাতলা পায়খানা করে সাওদা অছুস্ত হয়ে পড়ে। ইরপর রাতিই হাসপাতালে নি আসি। অ্যাকন অবস্তা কিচুডা ভালো।’

আরও পড়ুন

ডায়রিয়ার প্রকোপ

বিরূপ আবহাওয়া বরিশাল অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বিভাগের ৬ জেলায় ৩৪ হাজার ৯৩০ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিলের ২০ দিনে ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৮২৬ জন। আর গত এক সপ্তাহে হয়েছেন ২ হাজার ৫২৩ জন।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, চৈত্র-বৈশাখে পানিবাহিত রোগটির প্রকোপ দেখা দেয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নদী ও খালের পানি ব্যবহারকারীরা ডায়রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হন। ২০১৯ সাল থেকেই এই বিভাগে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। ধারাবাহিক তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টিহীনতা ডায়রিয়ায় আক্রান্তের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

প্রচণ্ড দাবদাহে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গরমজনিত রোগী ভর্তি বাড়ছে। তাদের মধ্যে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বেশি। গত শুক্রবার এই হাসপাতালে ৭০৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। গরমজনিত ডায়রিয়ার উপসর্গ নিয়ে বুধবার ভর্তি হয়েছেন ৫৫ জন, বৃহস্পতিবার ৫৭ ও শুক্রবার ৩৫ জন।

শিশু ওয়ার্ডের বারান্দার একাংশকে ডায়রিয়া ব্লক ঘোষণা করা হয়েছে। এই ব্লকের সামনে যেতেই দেখা যায়, একজন বাবা ওই ব্লক থেকে তাঁর ছেলেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কাঁধে নিয়ে বের হচ্ছিলেন আর তখনই ছেলেটি অচেতন হয়ে পড়ছিল। পরে চিকিৎসা পেয়ে তার চেতনা ফিরে আসে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র চিকিৎসক শঙ্কর কে বিশ্বাস বলেন, এবার স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু বেশি রোগী আসছেন গরমজনিত ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, পানিশূন্যতা, হিটস্ট্রোকের লক্ষণ নিয়ে।

পাবনা জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ৩৮ শয্যার শিশু ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি ছিল ১৬১ জন। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগী রয়েছেন ৫৭ জন। এর আগে শুক্রবার শিশু ওয়ার্ডে রোগী ছিল ১২৩ জন। এদিন ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগী ছিলেন ৪১ জন। হিসাব অনুযায়ী, শিশু ওয়ার্ডে প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে। নতুন করে ভর্তি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ জন।

আরও পড়ুন

ঢাকায় বহির্বিভাগে রোগী বাড়ছে

আট মাসের মাইশা ইসলামের চার দিন ধরেই প্রচণ্ড জ্বর, সঙ্গে সর্দি-কাশি। শেষমেশ হাসপাতালে মাইশাকে নিয়ে ছুটে এসেছেন মা আনোয়ারা বেগম। মিরপুরের এই বাসিন্দা বলেন, ঈদের ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ফেরার পরই মেয়ের জ্বর আসে। জ্বরের মাত্রা বেশি হওয়ায় তিনি ভয় পেয়েছেন। শিশু হাসপাতালে এসে দেখেন, তাঁর মতো আরও অনেকেই বাচ্চাদের একই সমস্যা নিয়ে এসেছেন।

কাল রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে গেলে দেখা যায়, তিন মাসের ওমরের নাকে-মুখে অক্সিজেন মাস্ক। মায়ের কোলে চড়ে সে নিচতলায় একটি পরীক্ষার জন্য গিয়েছিল। ফুফু অক্সিজেনের সিলিন্ডার টানছেন। মা লিমা জানান, তাঁদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ওমরের নিউমোনিয়া ধরা পড়েছে। এক সপ্তাহ বেসরকারি একটি হাসপাতালে কাটিয়ে শিশু হাসপাতালে এসেছেন পাঁচ দিন আগে।

সম্প্রতি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আইসিডিডিআরবি এক যৌথ পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে ইনফ্লুয়েঞ্জা (শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ) হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, পেশি ও জয়েন্টে ব্যথা, খারাপ লাগা বোধ করা, গলাব্যথা ও নাক দিয়ে সর্দি ঝরার মতো লক্ষণ দেখা দেয়; অর্থাৎ ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আবহাওয়ার বিরূপ পরিস্থিতি।

আরও পড়ুন

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বহির্বিভাগে দুই বছরের ছেলে আবু হুরাইরাকে চিকিৎসক দেখিয়ে ফিরছিলেন মামুন হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন দিন ধরে জ্বর, কাশি। গতকাল থেকে পেট খারাপও করেছে। আজ চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম। ওষুধ দিয়েছেন।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক শাহেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই সময়ে বহির্বিভাগের আসা রোগীর বেশির ভাগই সর্দি-জ্বর নিয়ে আসছেন। খুব জটিল না হলে ভর্তি রাখা হচ্ছে না। জ্বরের ধরন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এবারের জ্বর ১০৩ থেকে ১০৫ পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। মুখে খাওয়ার প্যারাসিটামলেও অনেক সময় জ্বর নামছে না বা নামলেও আবার একই মাত্রার জ্বর উঠছে। আইইডিসিআরের কাছে নমুনা পাঠানো হয়েছে ধরন বোঝার জন্য।

শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ও সহকারী অধ্যাপক ফারহানা আহমেদ বলেন, এখান গড়ে আড়াই শ রোগী আসছে সর্দি-জ্বর নিয়ে। সাধারণ কিছু বিষয় তিনি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে বলেন, প্রচুর পানি ও তরল-জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। ঘাম শুকিয়ে যায়, এমন সুতির জামা পরিয়ে রাখতে হবে। বাইরে থেকে আসার পর ঘাম মুছে দিতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না।

{তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রথম আলোপ্রতিনিধিরা}