পিটার আর কানের দিনপঞ্জি
রাও ফরমান আলী পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের বিষয়ে গোপন সমঝোতা করছেন
পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ছিলেন। ওই সময় প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখা পাঠানোর সুযোগ না পেয়ে দিনপঞ্জি রাখতে শুরু করেন তিনি। কয়েক দিনের দিনপঞ্জি একসঙ্গে পাঠালে তা প্রকাশ করত ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ওয়াল স্টিট জার্নাল তাঁর ৩ থেকে ১২ ডিসেম্বরের দিনপঞ্জি প্রকাশ করে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য আজ তাঁর ১১ ডিসেম্বরের দিনপঞ্জি তুলে ধরা হলো।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যসেবা-সংক্রান্ত গ্রন্থাগারে সকালের মাঝামাঝি বিস্ফোরণ হলো। ধ্বংসস্তূপ ১০০ গজ পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। ‘দ্য নিউক্লিয়ার ইয়ারস’ ও ‘দ্য রোল অব পপুলার পার্টিসিপেশন ইন ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক বই দুটিসহ বিভিন্ন বই রাস্তার চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল। এটি ধ্বংসযজ্ঞে জনপ্রিয় অংশগ্রহণের ভূমি। মুক্তিবাহিনী কি এটি করেছে? গ্রন্থাগারিক বললেন, যে ব্যক্তি বিস্ফোরণটি ঘটিয়েছে, সে উর্দুতে কথা বলছিল, যা কিনা পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা। কে জানে? কয়েক মিনিটের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ থেকে বইগুলো লুট হয়ে গেল। ‘রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিকস’ নামের একটি বই হাতের নিচে লুকিয়ে এক বৃদ্ধ চলে গেলেন।
দিনের সবচেয়ে বড় গুজব হলো মার্শাল ল আইনের উপপ্রশাসক এবং এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর ‘ভদ্রলোক জেনারেল’ নামে খ্যাত জেনারেল রাও ফরমান আলী খান পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর শর্ত সাপেক্ষে আত্মসমর্পণের বিষয়ে গোপন সমঝোতা করছেন, হয়তো জাতিসংঘের সঙ্গে। কিন্তু গুজব শোনাচ্ছে, এখানকার কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি ও ইসলামাবাদে প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খান তা জেনে ফেলেছেন। বলা হচ্ছে, এসবে বিশেষ বিমানে মানুষ সরিয়ে নেওয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা আজ আবার ফিরে আসেনি। বিমান নিয়ে সমস্যার একটি দিক হলো, রাজনৈতিক কারণে ভারত বলছে যে তারা কলকাতা থেকে বিমান উড়িয়ে ঢাকায় আনতে চায়। কিন্তু পাকিস্তান ওই একই রাজনৈতিক কারণে তাতে সম্মত হচ্ছে না।
আটকে পড়া বিদেশিরা বুঝতে পারছে যে তারা ক্রমে রাজনৈতিক ঘুঁটিতে পরিণত হচ্ছে। ক্রমেই বোধ হচ্ছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঢাকায় শেষ রক্ষার লড়াই করতে চায়। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, শহরে আরও অনেক সেনা নিয়ে আসা হচ্ছে বা তারা স্বেচ্ছায় ফিরে আসছে শহরে। শোনা যাচ্ছে, জেনারেল নিয়াজি বিমানবন্দরে এক সাংবাদিককে বলেছেন, ‘এখানে আমাকে মরতে দেখবেন আপনি।’
আমেরিকান দূতাবাসের অবস্থা বেশ নিম্নমুখী। বোঝা যাচ্ছে, আমেরিকা পরাজিতের পক্ষ নিচ্ছে এবং এর কারণে কূটনৈতিক ও অন্যান্য ফলাফল তাদের ভোগ করতে হবে। এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র পুরো ব্যাপারটায় গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছে।’ আজ দুপুরের পর শহরে কারফিউ জারি হয়েছে। রাস্তাগুলো একদম খালি। ধারণা করা হচ্ছে যে এখানকার ১৩ লাখ অধিবাসীর অর্ধেকের কম এখনো শহরেই আছে।
হোটেলে সভা ডেকেছে রেডক্রস। সভায় সভাপতিত্ব করেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ কর্নেল এবং এখন রেডক্রসের কর্মকর্তা। ভেরি ডেভিড নিভেন। চারপাশে ভেসে বেড়ানো নানা ধরনের গুজবের বিষয়ে পাত্তা না দিতে হোটেলে থাকা মানুষদের বলেছেন তিনি। কিন্তু তিনি এ-ও বলেছেন যে হোটেলের উঁচুতলায় বাস করা অতিথিরা কিছুটা নিচে নেমে আসতে চাইতে পারেন। তিনি আরও বলেছেন, হোটেলের নিরাপত্তাকর্মী মিস্টার বেগ শৌচাগারে বোমা নিষ্ক্রিয় করার মধ্য দিয়ে দারুণ কাজ করেছেন এবং সেগুলো একটি ট্রেঞ্চে পুঁতে রাখা হয়েছে, যাতে সুইমিংপুল আবার খোলা যায়। হাততালি। কিন্তু সতর্কতার বিষয় হলো, বিমানবিধ্বংসী বন্দুকের কিছু শার্পনেল সুইমিংপুল থেকে তোলা হচ্ছে। নিজ দায়িত্বেই তাই ঝাঁপ দিতে হবে।
সাংবাদিকেরা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে টেলিফোন করার চেষ্টা করে দেখছেন যে পাকিস্তানি বা ভারতীয় সেনাবাহিনী উত্তর দেয় কি না। বেশির ভাগ ফোনই বিকল হয়ে আছে, কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর খুলনায় আমরা যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম, যা অনুমিতভাবে কয়েক দিন আগে ভারতীয় বাহিনীর দখলে চলে গেছে। সার্জেন্টমতো কেউ ফোনে উত্তর দিল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভারতীয়রা কোথায়?’ একেবারে কাউবয় সিনেমার সংলাপ যেন! তিনি বললেন, ‘এখানে নেই।’
* ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনটির একাংশ আবার প্রকাশ করা হলো।