চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার নজির: অধ্যাপক সামছুল হক

বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে ফিরছিলেন বাসায়। পথে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে নিহত হয়েছেন পাঁচজন। সোমবার বিকেলে, ঢাকার উত্তরায়
ছবি: খালেদ সরকার

রাজধানীর উত্তরায় চলন্ত প্রাইভেট কারের ওপর নির্মাণাধীন উড়াল পথের গার্ডার পড়ে পাঁচজনের প্রাণহানির ঘটনাকে চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার নজির হিসেবে দেখছেন পরিবহনবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি বলেছেন, নির্মাণকাজে দুর্ঘটনা এড়াতে ঝুঁকি কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এরপরও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু এখানে সে সবের কিছুই ছিলো না।

সোমবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনে এই দুর্ঘটনা ঘটে। বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের উড়ালসড়কের গার্ডারটি ক্রেন দিয়ে ওপরে তোলার সময় সেটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে।

অধ্যাপক সামছুল হক বলেছেন, বড় নির্মাণকাজে ঝুঁকি এড়াতে যেসব পদক্ষেপ নিতে হয়, তা এখানে নেওয়া হয়নি।
ফাইল ছবি

ঢাকার দক্ষিণখানের কাওলা এলাকায় বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে নবদম্পতি ও তাঁদের পাঁচ স্বজন ওই গাড়ি করে আশুলিয়ায় যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার পরপর নবদম্পতি হৃদয় (২৬) ও রিয়া মনিকে (২১) গাড়ি থেকে বের করা হয়। তাঁরা উত্তরার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। দুজনই শঙ্কামুক্ত বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে ঘটনার সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় পর গার্ডার সরিয়ে প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

নিহতরা হলেন, হৃদয়ের বাবা মো. রুবেল হাসান (৫০), রিয়া মনির মা মোছা. ফাহিমা (৩৭), খালা ঝর্ণা (২৮) এবং ঝর্ণার দুই সন্তান জান্নাতুল (৬) ও মো. জাকারিয়া (৪)।

পুলিশ ও স্বজনেরা জানান, হৃদয় ও রিয়া মনির বিয়ে হয় গত শনিবার। সোমবার ছিল ছেলের বাড়িতে বউভাতের অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠান শেষে তাঁরা গাড়িতে আশুলিয়ায় মেয়ের বাড়িতে ফিরছিলেন। হৃদয়ের বাবা রুবেল হাসান একমাত্র ছেলে ও ছেলের বউকে গাড়িতে করে পৌঁছে দিচ্ছিলেন।

আরও পড়ুন

পথে এভাবে দুর্ঘটনায় তাঁদের প্রাণহানির জন্য চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গেজহোবা গ্রুপ ও সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি দেখছেন পুলিশের কর্মকর্তা ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা।

তাঁরা বলেছেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলাকালে নিরাপত্তার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতেই এ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটল।

পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কাজ করার সময় অবশ্যই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রাখার কথা। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজটি কেন করল, সেটি খতিয়ে দেখা হবে। তাদের গাফিলতি ছিল।

বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কে বাসের আলাদা লেন নির্মাণ করা হচ্ছে। এটাই বিআরটি প্রকল্প। প্রকল্পের মূল বাস্তবায়নকারী সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, যে ক্রেন দিয়ে গার্ডার ওঠানো হচ্ছিল, সেটি গার্ডারের ওজন নিতে না পেরে কাত হয়ে আছে। আর গার্ডারটির নিচে চাপা পড়ে আছে প্রাইভেট কারটি।

আরও পড়ুন

চাপাপড়া গাড়ির পেছনে আরেকটি গাড়িতে ছিলেন নিহত ফাহিমার ভাই জাহিদ হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটি হত্যাকাণ্ড। রাস্তায় কোনো ‘ব্যারিকেড’ (নিরাপত্তাবেষ্টনী) ছিল না। ক্রেন কাত হয়ে চলন্ত গাড়ির ওপর গার্ডার পড়েছে। জাহিদ হাসান বলেন, ‘আমি গিয়ে দেখি আমার ভাগনে ও বোন জীবিত। শ্বাস চলছে। হৃদয়ের (বর) বাবা রুবেলের হাত কাঁপছে। সময়মতো উদ্ধার করা গেলে তাঁরা বেঁচে যেতেন।’

প্রাইভেট কারে ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে নিহত ব্যক্তিদের এক স্বজনের আহাজারি। সোমবার বিকেলে, ঢাকার উত্তরায়
ছবি: খালেদ সরকার

দুর্ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলেও উদ্ধার তৎপরতা শুরু করতে দেরি হয়। এর কারণ ব্যাখ্যায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলেন, গার্ডারটির ওজন অনেক বেশি ছিল। এ ধরনের গার্ডার সরানোর মতো সরঞ্জাম ফায়ার সার্ভিসের নেই। এ কারণে ঘটনাস্থলে গিয়েও তৎক্ষণাৎ চাপাপড়া মানুষদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যে গার্ডারটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়েছিল, সেটির ওজন ৪০ থেকে ৪৫ টন বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।

আরও পড়ুন

উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক সাইফুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, গার্ডার সরাতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা আসতে দেরি করায় তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করা যায়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন আসার পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে গার্ডার সরিয়ে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

এই অব্যবস্থাপনার দিকে ইঙ্গিত করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ব্যস্ত সড়কে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা না দিয়ে ভারী গার্ডার তোলা হচ্ছে। দুর্ঘটনার পর উদ্ধারে ক্রেন কিংবা আহতদের নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সও থাকার কথা, যা ছিলো না। এটি চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার নজির।

আরও পড়ুন

এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী জানিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনা কেন ঘটেছে, কারা দায়ী, সেটি কমিটি খুঁজে বের করবে। মঙ্গলবার সকালের মধ্যেই প্রতিবেদন পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা করছেন।

গার্ডারটি সরানোর পর প্রাইভেট কার থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচজনের মরদেহ। সোমবার সন্ধ্যায়, ঢাকার উত্তরায়
ছবি: খালেদ সরকার