অধরা নাগরবাটই

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের কুরমা চা–বাগানে একটি স্ত্রী নাগরবাটই
ছবি: লেখক

সহকর্মী অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ শ্রীমঙ্গলের রাধানগরের রিসোর্টে যখন পৌঁছালাম, তখন বেলা দেড়টা ছুঁই ছুঁই। দ্রুত দুপুরের খাবার সেরে যাত্রা করলাম ৩০ কিলোমিটার দূরের কমলগঞ্জ উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী কুরমা টি এস্টেটের দিকে। কুরমাছড়ায় পৌঁছালাম সাড়ে তিনটা নাগাদ। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন শ্রীমঙ্গলের খুকন থৌনাউজাম। গাড়ি থেকে নেমেই অধরা পাখিটির খোঁজে চলে গেলাম মাঠে।

কিন্তু পাখিটিকে খুঁজে পাওয়া কি এত সহজ! বিপদের আশঙ্কা দেখলে সে চুপটি করে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। পালকের রং এমন যে তা ওকে পরিবেশের সঙ্গে মিশে থাকতে সাহায্য করে। কেউ পাখিটির ১-২ ফুটের মধ্যে চলে এলে তখন বাধ্য হয়েই সে উড়াল দেয়; আর তখনই চোখে পড়ে। এ কারণে ছবি তোলা বেশ কঠিন।

চা-বাগানে পাখিটির অবস্থানের আশপাশে প্রায় ৫০ মিনিট ঘোরাঘুরির পর আমার পায়ের ২-৩ ফুট পাশ থেকে সে উড়ল। ক্যামেরা প্রস্তুত ছিল। মাত্র তিনটি ক্লিক করতে পারলাম। ছবি উঠল পেছন দিক থেকে; তবে সব কটিই ঝাপসা।

সেই ২০১২ সালে ফকিরহাটের সাতশৈয়া গ্রামে এই পাখির প্রথম ছবি তোলার পর এ পর্যন্ত পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া, রাজশাহীর সিমলা পার্ক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাবুডাইংয়ে এটিকে বারবার দেখেও একটি স্পষ্ট ছবি তুলতে পারিনি। যাহোক, কুরমা চা-বাগানে প্রথমবার দেখার তিন মিনিটের মধ্যে এক জোড়া পাখিকে চা–গাছের তলা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম। মুহূর্ত দেরি না করে ক্লিক করলাম। মোটামুটি মানের দু-তিনটি ছবি উঠল, তবে শুধু স্ত্রী পাখিটির। পুরুষটিকে আর দেখলাম না।

বহু সাধনার পর যার ছবি তুললাম, সেটি এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি নাগরবাটই। বাটই, ভাটি, বদহি, বুড়া বটের, ব্যাংবুড়িয়া বা গুলু (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম বার্ড বাটনকোয়েল বা কমন বাটনকোয়েল। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Turnix suscitator

একনজরে নাগরবাটই গোলগাল ও তুলতুলে পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য ১৩ দশমিক ৫ থেকে ১৭ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার, প্রসারিত ডানা ৩৫ থেকে ৫২ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৪৭ থেকে ৬৮ গ্রাম। আকারে স্ত্রী কিছুটা বড়। পুরুষের পিঠ লালচে-বাদামি ও ধূসর-কালো। ডানার পালক ঢাকনিতে খাড়া, কালো ও কিছুটা পীতাভ ডোরা থাকে। থুতনি ও গলা সাদাটে। থুতনি ও বুকে কালো দাগ। পেট কমলা-লাল। স্ত্রী বেশি বর্ণিল। স্ত্রীর থুতনি, গলা ও বুকের মাঝখানটা লালচে। গলা ও বুকজুড়ে কালো ও পীতাভ ডোরা থাকে। স্ত্রী–পুরুষ–নির্বিশেষে চোখের রং হলদে। চঞ্চু স্লেট-নীল, যার গোড়া গাঢ় বাদামি। পা ও পায়ের পাতা ধূসর।

দেশব্যাপী তৃণভূমি, ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকা, ধানখেত ইত্যাদি জায়গায় এরা একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। অত্যন্ত গোপনে চলাফেরা করে বলে সহজে নজরে পড়ে না। মাটিতে হেঁটে হেঁটে ঝরাপাতা উল্টে বীজ, শস্যদানা, ঘাসফড়িং, উইপোকা, পিঁপড়ে, পোকামাকড় ইত্যাদি খায়।

জুন থেকে অক্টোবর প্রজননকাল। এ সময় ঝোপজঙ্গল, ঘাসবন বা শস্যখেতে সরু ঘাস ও লতা বিছিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে চারটি, রং লালচে-বাদামি বা কালচে-বেগুনি দাগছোপসহ ধূসর-সাদা। ডিম পাড়ার পরই স্ত্রী পাখি অন্য পুরুষ পাখির সঙ্গে জোড় বাঁধে ও ডিম-ছানা তোলে। স্ত্রী ডিমে তা–ও দেয় না, ছানার যত্নও নেয় না। এ কাজ পুরুষের ওপরই বর্তায়। ডিম ফোটে ১৩-১৪ দিনে। ছানারা ৪০ দিনে পূর্ণাঙ্গ পাখিতে পরিণত হয়। আয়ুষ্কাল তিন-চার বছর।