মৌলভীবাজারের জুড়ীর সাগরনাল বন বিটের পাকুড়গাছে ফল মুখে স্ত্রী নীলপরি
ছবি: লেখক

পাখিটি প্রথম দেখি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বার্ড পার্কে ২০০৪ সালে। প্রথম দর্শনেই নীল-কালো পাখিটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম। দেশে ফেরার প্রায় আট বছর পর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মৌলভীবাজারের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে পলকের জন্য স্ত্রী পাখিটিকে দেখেছিলাম। কিন্তু ছবি তুলতে পারিনি।

এরপর গত পাঁচ বছর কত না জায়গায় পাখিটি খুঁজেছি, কিন্তু দেখা পাইনি। গত বছর নভেম্বরে এটির খোঁজে জুড়ীর মুড়াছড়া ইকোপার্ক ও সাগরনাল চা-বাগানে যাই; কিন্তু ফল একই। নতুন বছরের শুরুতে ৪ জানুয়ারি আবারও সাগরনাল বন বিটের নাম না জানা এক পাহাড়ে উঠলাম। পাহাড়ের শতবর্ষী এক পাকুড়গাছের ফল পাখিটির অত্যন্ত প্রিয়। এর আগে যারাই এসেছে, তারাই এটিকে সেই গাছে পেয়েছে। কিন্তু সকালে গাছে পাখিটি দেখলাম না। দুপুর ১২টায় পাহাড় থেকে নেমে ছড়ার দিকে গেলাম। ছড়া ও চা-বাগানের আশপাশে ঘোরাফেরা করে তেমন কোনো পাখির দেখা না পেয়ে আবারও বেলা তিনটা নাগাদ পাহাড়ে উঠলাম। গাছে বহু প্রজাতির পাখির মেলা বসেছে যেন! বিরামহীনভাবে ক্যামেরার শাটারে ক্লিক করে গেলাম। প্রায় আধঘণ্টা পর একটি পাখি এসে ডালে বসল; কিন্তু কয়েকটা ক্লিক করতেই উড়ে গেল। আবারও অপেক্ষার পালা। আরও প্রায় আধঘণ্টা পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রথমে পুরুষ ও পরে স্ত্রী পাখি এসে ফলপূর্ণ পাকুড়গাছে বসল ও ক্ষুধা নিবারণের জন্য ফলের বৃন্তে চঞ্চু চালাতে লাগল। ছবি তোলার জন্য এবার বেশ সময় পাওয়া গেল। বিকেল পাঁচটায় পাহাড় থেকে নেমে আসার আগপর্যন্ত ক্যামেরার শাটারে ক্লিক করে গেলাম।

এতক্ষণ নীল-কালো পালকে মোড়া অনিন্দ্যসুন্দর যে পাখিটির কথা বললাম, সেটি এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি নীলপরি। ইংরেজি নাম এশিয়ান ফেইরি ব্লুবার্ড। আইরেনিডি গোত্রের নীলপরির বৈজ্ঞানিক নাম Irena puella। পাখিটির বৈশ্বিক বিস্তৃতি এশিয়া মহাদেশে সীমাবদ্ধ; বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাস করে।

নীলপরি মাঝারি আকারের পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের দৈর্ঘ্য ২৪-২৭ সেন্টিমিটার। ওজনে পুরুষ ৫৬-৭৭ ও স্ত্রী ৫১-৭১ গ্রাম হয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষের পালকের রঙে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষের দেহের ওপরের অংশ, অর্থাৎ মাথার চাঁদি থেকে পিঠ হয়ে কোমর পর্যন্ত উজ্জ্বল চকচকে বেগুনি নীল। লেজ, ডানা ও দেহের নিচের অংশ চকচকে কালো। উভয় ডানার ওপর দুটি করে বেগুনি নীল ফোঁটা রয়েছে। চিবুক ও মুখমণ্ডল গাঢ় মখমলে কালো; লেজতল-ঢাকনি নীলচে। চঞ্চু সোজা ও কালো। অন্যদিকে ডানা ও লেজ বাদে স্ত্রী ও এক বছর বয়সী পুরুষের পালক ফ্যাকাশে নীলচে সবুজ। ডানা ও লেজ ফ্যাকাশে কালো; ডানার প্রান্ত নীলচে ধূসর। চঞ্চু বাদামি কালো। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে চোখ গাঢ় লাল এবং পা, পায়ের পাতা ও নখ কালো। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে অনেকটা স্ত্রী পাখির মতো; তবে ওদের ডানা বাদামি।

জুড়ীর সাগরনাল বন বিটের পাকুড়গাছে পুরুষ নীলপরি
ছবি: লেখক

নীলপরি সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন ও আশপাশের এলাকায় বাস করে। সচরাচর একাকী, জোড়ায় বা পাঁচ-ছয়টির ছোট দলে থাকে। দিবাচর পাখিগুলো মূলত পাকা ফল ও ফুল-ফুলের রস খায়। মাঝেমধ্যে পোকামাকড়ও খেতে পারে। দিবাচর পাখিগুলো সচরাচর ফলদ গাছের ওপরেই বিচরণ করে। তবে ফল ও পোকামাকড়ের জন্য ঝোপঝাড়েও নামতে পারে। সচরাচর ‘উইট উইট উইট...’ শব্দে ডাকে।

জানুয়ারি থেকে জুন প্রজননকাল। এ সময় ভূমি থেকে দুই-ছয় মিটার উঁচুতে গাছের দোডালায় ঘন পাতার আড়ালে পাতার শিরা ও ক্ষুদ্র মূল দিয়ে মাচা বা পিরিচ আকারের ঢিলেঢালা বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি; রং হালকা সবুজাভ, যার ওপর থাকে গাঢ় বাদামি ছিট-ছোপ। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে ডিমে তা দেয় ও প্রায় দুই সপ্তাহে ডিম ফোটে। ছানারা ১১-১৭ দিনে উড়তে শেখে। মা-বাবা উভয়েই ছানাদের যত্ন করে ও খাওয়ায়। বুনো পরিবেশে আয়ুষ্কাল ১০-১২ বছর হলেও আবদ্ধাবস্থায় ১৫ বছরের বেশি বাঁচে।