আমাদের তিন প্রজাতির ভোঁদড়

রাজশাহীর পদ্মা নদীর চর খানপুরে মসৃণ উদ
ছবি: লেখক

ঘুম থেকে উঠে লঞ্চের কেবিন থেকে বের হতেই ঘন কুয়াশায় থমকে দাঁড়ালাম। কুয়াশা কেটে না যাওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই সুন্দরবনের কোকিলমনির আগুনজ্বলা খালে ঢোকা যাবে না ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঘণ্টা দেড়েক পশুর নদে ভাসমান জেলিফিশের ছবি তুলে কাটালাম।

সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে কুয়াশা কাটতেই বোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অনিন্দ্যসুন্দর ওই খাল। সাত প্রজাতির মাছরাঙার দেখা মেলে সেখানে। খালে ঢোকার মুখেই একটি কালো-টুপি মাছরাঙা আমাদের অভিবাদন জানাল যেন! ওটির ছবি তোলা শেষ হতেই চার জোড়া বিস্ফারিত চোখ মুহূর্তের জন্য আমাদের চোখে আটকে গেল! সংবিৎ ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বিরল চারটি প্রাণী বনের দিকে ভোঁ-দৌড় দিল।

বোট থামিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। খানিকক্ষণ পর নিরাপদ মনে করায় ওগুলো ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল। সবচেয়ে সামনে থাকা প্রাণীটি মানুষের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। এরপর কান খাড়া করে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। পেছনে থাকা বাকি তিনটিও একই কাজ করল। এরপর ধীরে ধীরে খালের পাড়ে এসে দাঁড়াল। আরেকবার কান খাড়া করে সজাগ দৃষ্টিতে আশপাশ দেখে নিল। আমরা টুঁ–শব্দ না করায় ওগুলোর ভয় কেটে গেল।

মনোযোগ দিল খালে নেমে মাছ শিকারে। মিনিট দশেক শিকারের পর খালের পাড়ে উঠে কোনোটি মাটিতে, কোনোটি গাছের গুঁড়িতে গা এলিয়ে দিল। আহা, কী আরাম! একসময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। আগেও প্রাণীগুলোকে বেশ কয়েকবার দেখেছি। কিন্তু কখনো এভাবে বিশ্রাম বা তন্দ্রাচ্ছন্ন হতে দেখিনি। কাজেই একটি নতুন অভিজ্ঞতা হলো। তন্দ্রা কেটে গেলে আবারও খালে নামল। আমরা চুপি চুপি প্রাণীগুলোর আশপাশে থেকে প্রায় আধঘণ্টা ছবি তুলে বিদায় হলাম।

সুন্দরবনের কোকিলমনির স্তন্যপায়ী বিরল প্রাণীগুলোর মধে৵ রয়েছে ভোঁদড়, উদবিড়াল, ধাইড়া উদ বা ছোট উদ। ইংরেজি নাম ওরিয়েন্টাল স্মল-ক্লড ওটার। এ দেশের তিন প্রজাতির ভোঁদড়ের মধ্যে ওগুলোই সবচেয়ে ছোট এবং সচরাচর চোখে পড়ে। বিশ্বের ক্ষুদ্রতম ভোঁদড় প্রজাতিও এটি।

সব ভোঁদড়ই মাস্টেলিডি গোত্রের। ছোট উদের বৈজ্ঞানিক নাম Aonyx cinerea। একসময় দেশের অগভীর স্বাদুপানির জলপ্রবাহ ও নদী, উপকূলীয় অঞ্চল ও বাদাবনের পানিতে বিচরণ করলেও বর্তমানে এই বিপন্ন প্রাণীগুলোকে মূলত সুন্দরবনেই দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ৪৫ থেকে ৬১ সেন্টিমিটার এবং লেজ ২৫ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার লম্বা। ওজন ২.৭ থেকে ৫.৪ কেজি।

রাজশাহীর পদ্মা নদীর চর খানপুরে ছোট উদের চেয়ে বড় ও মসৃণ লোমে আবৃত দেহের এক জোড়া ভোঁদড় দেখেছিলাম ২০১৬ সালে। বর্তমানে ওগুলো বেশ বিরল ও মহাবিপন্ন। মূলত দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে বেশি দেখা যায় ওসব ভোঁদড়। নিচু ভূমি, উপকূলীয় বাদাবন, পচা উদ্ভিদসমৃদ্ধ জলাবন, স্বাদুপানির জলাভূমি, হ্রদ ও ধানখেতে বাস করে ওগুলো।

তিন প্রজাতির ভোঁদড়ের মধ্যে বর্তমানে যেগুলো সবচেয়ে কম দেখা যায়, সেগুলোর নাম উদবিড়াল, উদ, ভোঁদড় বা ধাইড়া।

আ ন ম আমিনুর রহমান, অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর