কানা বগীর ছা

সাতক্ষীরার সেই কানা বগীর ছা
ছবি: রাশেদ বিশ্বাস

ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। ৫০ ফুট উঁচু মেহগনিগাছের মগডালের বাসা থেকে বকের একটি পিচ্চি ছানা পাকা আম পড়ার মতো গাছতলার মানকচু ঝাড়ের একটি বড় পাতার ওপরে পড়ে সুড়ুৎ করে পিছল খেয়ে মাটিতে পড়ল। দৃশ্যটা দেখে বাড়ির মালিক ফোস্ত হালদার ছানাটিকে কুড়িয়ে এনে ঝুড়ির তলায় রাখলেন। বকের বাসা থেকে মাত্র তিন হাত দূরেই ফিঙের জাতভাই সিংহরাজের (Greater Racquet tailed Drongo) বাসা। মিলেমিশে আছে দুই জাতের পাখি।

যাহোক, হালদার সাহেবের বাড়ির আঙিনায়ই তো মেহগনিগাছটা, তাঁর আছে বাল্য-কৈশোরের নানারকম অভিজ্ঞতা— বকের ছানা পোষা ও ফাঁদ পেতে বক ধরা। অতএব, পরপর দুই দিন তিনি ছানাটিকে কুঁচো চিংড়ি ও চেলা-পুঁটি মাছ খাওয়ালেন। ওই দুই দিনই বায়েজিদ (১৫) নামের এক কিশোরকে ৫০ ফুট উঁচু গাছটিতে চড়িয়ে ছানাটিকে বাসায় তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কোমরে চটের ব্যাগ গুঁজে তার ভেতরে ছানাটি রেখেই বায়েজিদ দুই দিন গাছে চড়েছিল; কিন্তু মাথা, পিঠ ও কানে সিংহরাজের ঠোকর ও গালাগাল হজম করেও লাভ হয়নি কিছুই। গাছ থেকে নামার আগেই তুলে রাখা ছানাটি আবারও বাসা থেকে পড়ল কচুগাছের ওপর।

কেন পড়ল? প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, বাকি দুটি ছানা অপেক্ষাকৃত ছোট তথা সেগুলোর তুলনায় দুর্বল ছানাটিকে পুঁচকে পাখা দিয়ে ঠেলে ও ঠুকরে বাসা থেকে ফেলে দিয়েছিল ইচ্ছা করেই। যাতে মা-বাবার আনা খাবার শুধু তারাই খেতে পারে। সব বকের ছানার নীতি হলো, ‘একা খাব, একা খাব।’ এ জন্য বাসার ছানাগুলোর মধে৵ ভয়ংকর লড়াইও হয়।

এসব বকের এ রকম প্রবণতা আমি বাল্য-কৈশোরে দেখেছি বহুবার। বহুবারই বাচ্চা পুষেছি। এসব বকের (ছানাগুলোরও) আরও একটি ভয়ংকর প্রবণতা এরকম যে মানুষসহ শত্রুর কবলে পড়লে মানুষ বা শত্রুর চোখের মণিতে নিজের প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব দেখে চরম আক্রোশে এরা ঠোকর দেয়। তীক্ষ্ণèসুচালো ঠোঁটের আঘাতে একজন মানুষের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনাও আমার জানা আছে। নিজেও বাসার ছানা আনতে গিয়ে ও ফাঁদে পড়া বক ধরতে গিয়ে নাক, কপাল, মুখ ও হাতে ঠোকর খেয়েছি। গ্রামবাংলার বহু মানুষেরই এ রকম অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি আছে। এ বকের ঠোঁট এতই শক্ত ও ধারালো যে হাতে ধরে সজোরে সরু কলাগাছে আঘাত করলে গাছটি এ–ফোঁড় ও–ফোঁড় হয়ে যাবে। তাই তো প্রচণ্ড ঠোকরে এই বক কাঁকড়া ও কাছিম ছানার পিঠের নরম খোল ফুটো করতে পারে।

যাহোক, বর্ণিত ঘটনাটি গত মে মাসের ৫ তারিখের। স্থান সাতক্ষীরার তালা উপজেলার আগোলঝাড়া গ্রাম। ওখানকার ‘ওয়াইল্ডলাইফ মিশন’-এর সেক্রেটারি রাশেদ বিশ্বাস টেলিফোনে আমাকে বিস্তারিত জানান। সেই বাসার দুটি বাচ্চা বাসা ছেড়ে উড়ে গেছে। আর সেই মাটিতে পড়া পিচ্চিটা সুযোগ পেয়ে পালিয়ে গেছে। সিংহরাজ দম্পতিও বাচ্চা নিয়ে বাসা ছেড়েছে। ফিঙে যদি হয় পাখির রাজা, তাহলে সিংহরাজ বা ভীমরাজ হলো মহারাজা। ইগল ও বাজ কাউকেই ভয় করে না এই পাখি, আক্রমণ করে। বহু নিরীহ পাখি তাই সিংহরাজের বাসার সীমানার ভেতরে বাসা করে নিরাপত্তা পেতে।

‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ/ ঐ আমাদের গাঁ,/ ঐখানেতে বাস করে/ কানা বগীর ছা।’ কবি খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীনের সেই কানা বগীরই ছা এটি। সারা বাংলাদেশে আছে এটি, প্রায় সবাই চেনে। এ ছাড়া কানিবক, কোঁচবক, কুরচে বক নামেও এটি পরিচিত। ইংরেজি নাম Indian pond heron, বৈজ্ঞানিক নাম ardeola grayii। দৈর্ঘ ৪৫ সেন্টিমিটার, ওজন ২১৫ গ্রাম। মূল খাদ্য ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙ ও পোকামাকড়। কেঁচো, ঢোঁড়া ও মেটে সাপের পিচ্চি ছানা গেলে এরা নুডলসের কায়দায়। বাসা বাঁধার মৌসুম শীত থেকে শরৎকাল। ডিম পাড়ে তিন থেকে পাঁচটি। ডিম ফুটে ছানা হয় ১৫ থেকে ১৮ দিনে।

লেখা: শরীফ খান, পাখি ও বন্য প্রাণিবিষয়ক লেখক