কালো ইগলের কথা

সেই কালো ইগলটি
ছবি: এস আই সোহেল

গত মে মাসের এক রাতে কুষ্টিয়া শহর থেকে ফোন করলেন বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী এস আই সোহেল। মেহেরপুরের গাংনী এলাকা থেকে তাঁর কাছে একটি কালো ইগল বা বহুরূপী ইগল এসেছে। পাখিটি অপ্রাপ্তবয়স্ক, ঝড়ের তোড়ে গাছের বাসা থেকে পড়ে বেশ আহত ও ক্ষুধার্ত ওটা।

তাঁর কাছে পাঠানোর কারণ, গত প্রায় ৩০ বছরে তিনি বহু পাখি, বুনো খরগোশসহ অন্যান্য বন্য প্রাণী শিকারিদের হাত থেকে উদ্ধার করে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করেছেন। আহত বহু পাখিকেও নিজেদের বাড়ির ছাদে রেখে সেবা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে অবমুক্ত করেছেন। কুষ্টিয়াসহ আশপাশের এলাকাগুলোয় তিনি যথেষ্ট পরিচিত।

পাখিটিকে নিয়ে গেলেন কুষ্টিয়া পশু হাসপাতালে। পশুচিকিৎসক কিশোর কুমার কুন্ডু পাখিটিকে দেখলেন ভালোভাবে, আহত পা ও ডানার জন্য দিলেন এইচ সিরাপ, বনাসল সিরাপ। দিলেন অন্য কিছু ওষুধও। সোহেল বাজার থেকে গরু-ছাগলের মাংস কিনে মাংসের কিমা খাওয়ালেন পাখিটিকে।

আমিও আমার সামান্য অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁকে খাবারের তালিকা দিলাম। কেননা, শৈশব থেকে তরুণবেলা পর্যন্ত আমি ও আমরা মোট তিনবার দুটি করে ‘কুড়াবাজের’ (Pallas’s Fish Eagle) বাচ্চা পুষেছিলাম। ওগুলোকে খেতে দিতাম গরু-ছাগল-মুরগির নাড়িভুঁড়ি, মাছের টুকরা, আপেল শামুকের মাংস, ব্যাঙ ও হাঁস-মুরগির ডিমের কুসুম।

বাড়ির আঙ্গিনার গাছপালায় থাকত সেগুলো। সোহেলের ইগলটি ছাদজুড়ে হেঁটে বেড়াত। ৫ দিন পর সোহেল তাঁর ১৫ বছর বয়সী মেয়ে মান্দিপা খুশবুকে নিয়ে ছাদে হাঁটছিলেন। একটু পর ইগলটি উড়াল দিল। চলে গেল চোখের ফ্রেমের বাইরে। সোহেল ফোন করে সুখবরটা জানালেন আমাকে।

শিকারি এই পাখির নাম কালো ইগল ও বহুরূপী ইগল। কালাবাজ ও শিখাযুক্ত ইগল নামেও পরিচিত। হলদেটে পা দুখানা লম্বা, লম্বা লেজও। মাথার পেছনে ছোট ঝুঁটি। এগুলোর শরীরে যখন বাদামি বা হালকা রং থাকে, তখন একনজরে ঘন বাদামি পিঠ; বুক-পেট ও দুখানা পা ঢাকা পালকের রং সাদাটে। শরীরের রং যখন গাঢ় কালচে, তখন একনজরে পাখিটি ঘন কালচে-বাদামি বা হালকা কালো।

অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির রং হালকাই থাকে। কালো ইগলের দলে কম করে দুটি স্তরভুক্ত নমুনা নজরে পড়ে—বাদামি ও কালচে। ধারণা করা হয়, প্রতিটি ঋতুতে এগুলোর রং অল্প অল্প করে বদলায়। ২০০০ সালে নরসিংদীর চরসিন্দুরের সরওয়ার পাঠান একটি আহত কালো ইগলের বাচ্চাকে সুস্থ করেছিলেন মাসখানেক সেবাযত্নœকরে। পরে আমি গিয়ে সেটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবমুক্ত করেছিলাম।

কালো ইগল বাসা করে উঁচু গাছের মগডালে। বছরের পর বছর একই বাসা ব্যবহার করতে পারে। শীত থেকে গ্রীষ্মকালের ভেতর একটি মাত্র ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে ছানা হয় ২৭-৩০ দিনে।

এগুলোর ইংরেজি নাম Changeable Hawk-Eagle. বৈজ্ঞানিক নাম Nisaetus cirrhatus. দৈর্ঘ্য ৭১ সেমি। ওজন ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৯ কেজি। মূল খাদ্য ইঁদুর, তক্ষক, ব্যাঙ, ছোট সাপসহ ছোট পাখি ও পাখির ডিম-ছানা।

শরীফ খান, পাখি ও বন্য প্রাণীবিষয়ক লেখক