কোন সংকেতের কী মানে

ঘূর্ণিঝড়ের সময় এভাবে প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে ঘুরে ঝড়ের সংকেত প্রচার করেন ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবকেরা। গত বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আগে বঙ্গোপসাগর তীরের তালতলী উপজেলায়
ফাইল: ছবি

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট  ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ বর্তমান গতিপথ না বদলালে বাংলাদেশে তেমন একটা আঘাত হানার আশঙ্কা দেখছেন না আবহাওয়াবিদেরা। তবে এর প্রভাবে সুন্দরবন এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী, কোথাও কোথাও প্রবল বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টির আশঙ্কা আছে। তবে আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ যেকোনো মুহূর্তেই পরিবর্তন হতে পারে। তাই আসন্ন এই ঘূর্ণিঝড় নিশ্চিতভাবে কোথায় আঘাত হানবে, সেটা সুনিশ্চিত হতে আরও দু-এক দিন সময় লাগতে পারে।

নিম্নচাপ থেকে সোমবার ভোরে এটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। আগে থেকে ঠিক করে রাখা তালিকা অনুযায়ী এটির নাম হয় ‘ইয়াস’। মূলত ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন ও ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়ার সদস্যদেশগুলো ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে।

তবে ঘূর্ণিঝড়টি যেখানেই আঘাত হানুক না কেন, এ নিয়ে বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক-উদ্বেগ বাড়ছে। প্রশাসনও ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ৯১৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেখানে ঝুঁকিপ্রবণ এলাকার ২০ লাখ লোককে তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপদে সরিয়ে আনা যায়, সে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে আবহাওয়া বিভাগ মোংলা ও পায়রা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত জারি করেছে।

আবহাওয়া বিভাগ বলছে, বিভিন্ন সংকেতের মানে এবং ঝড়ের মাত্রা ও ক্ষয়ক্ষতি ভিন্ন রকমের অর্থ। ঘূর্ণিঝড়সহ অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে আবহাওয়া অধিদপ্তর কিংবা স্থানীয় প্রশাসন নানা ধরনের সতর্কসংকেত মাইকে প্রচার করে। এর মাধ্যমে এলাকাবাসীকে সতর্ক করতে চায়। কিন্তু উপকূলের অধিকাংশ মানুষই তা বোঝেন না। তাই তাঁরা ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান না। আর এ কারণে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয় তাঁদের। আসুন, তাই জেনে নিই, কোন সংকেতের মানে কী।

ঘূর্ণিঝড়ের সময় এভাবে প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে ঘুরে ঝড়ের সংকেত প্রচার করেন ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবকেরা। গত বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আগে বঙ্গোপসাগর তীরের তালতলী উপজেলায়
ফাইল ছবি

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, দুর্যোগ-পূর্ববর্তী এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন সংকেত মাইকে প্রচার করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—দূরবর্তী সতর্কসংকেত, দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত, স্থানীয় সতর্কসংকেত, স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত, বিপৎসংকেত, মহাবিপৎসংকেত ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত।

ঝড়ের সময় আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া সমুদ্রবন্দরের ক্ষেত্রে ১১টি এবং নদীবন্দরের ক্ষেত্রে ৪টি সংকেত নির্ধারিত আছে। এই সংকেতগুলো সমুদ্রবন্দর ও নদীবন্দরের ক্ষেত্রে ভিন্ন বার্তা বহন করে।

সমুদ্রবন্দরের জন্য ১১টি সংকেত

১ নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত: জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে পারে। দূরবর্তী এলাকায় একটি ঝোড়ো হাওয়ার অঞ্চল রয়েছে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬১ কিলোমিটার। ফলে সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হবে।

২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত: গভীর সাগরে একটি ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। বন্দর এখনই ঝড়ে কবলিত হবে না, তবে বন্দর ত্যাগকারী জাহাজ পথে বিপদে পড়তে পারে।

৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত: বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর দুর্যোগকবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিলোমিটার হতে পারে।

৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত: বন্দর ঘূর্ণিঝড়–কবলিত। বাতাসের সম্ভাব্য গতিবেগ ঘণ্টায় ৫১-৬১ কিলোমিটার। তবে ঘূর্ণিঝড়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার মতো তেমন বিপজ্জনক সময় হয়নি।

৫ নম্বর বিপৎসংকেত: বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

৬ নম্বর বিপৎসংকেত: বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতার এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

৭ নম্বর বিপৎসংকেত: বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতার এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরের ওপর বা এর কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত: বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে পারে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা এর বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে।

৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত: বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা এর বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে।

১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত: বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তার বেশি হতে পারে।

১১ নম্বর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত: আবহাওয়ার বিপৎসংকেত প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং স্থানীয় আবহাওয়া কর্মকর্তা পরিস্থিতি দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করেন।

নদীবন্দরের জন্য চারটি সংকেত

১ নম্বর নৌ সতর্কতা সংকেত: বন্দর এলাকা ক্ষণস্থায়ী ঝোড়ো আবহাওয়ার কবলে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিবেগের কালবৈশাখীর ক্ষেত্রেও এই সংকেত প্রদর্শিত হয়। এই সংকেত আবহাওয়ার চলতি অবস্থার ওপর সতর্ক নজর রাখারও তাগিদ দেয়।

২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত: বন্দর এলাকায় নিম্নচাপের সমতুল্য তীব্রতার একটি ঝড়, যার গতিবেগ ঘণ্টায় অনূর্ধ্ব ৬১ কিলোমিটার বা একটি কালবৈশাখী, যার বাতাসের গতিবেগ ৬১ কিলোমিটার বা তদূর্ধ্ব। নৌযান এদের যেকোনোটির কবলে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ৬৫ ফুট বা তার কম দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট নৌযানকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে।

৩ নম্বর নৌ বিপৎসংকেত: বন্দর এলাকা ঝড়ে কবলিত। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ একটানা ৬২-৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিবেগের একটি সামুদ্রিক ঝড় শিগগিরই বন্দর এলাকায় আঘাত হানতে পারে। সব নৌযানকে অবিলম্বে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে।

৪ নম্বর নৌ মহাবিপৎসংকেত: বন্দর এলাকা একটি প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার সামুদ্রিক ঝড়ে কবলিত এবং শিগগিরই বন্দর এলাকায় আঘাত হানবে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তদূর্ধ্ব। সব ধরনের নৌযানকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে।