ক্ষতবিক্ষত নৈসর্গিক শ্বাসমূলীয় বন

সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন। একই সঙ্গে বন, জলাভূমি, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত এমন প্রাকৃতিক বন পৃথিবীতে দেখা যায় না।

লোকজ এবং প্রথাগত জ্ঞান ব্যবহার করে সমন্বিত চাষব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন খায়বার সরদার।ছবি: সংগৃহীত

এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। বিষ দিয়ে চলছে সর্বনাশা মাছ শিকার। ধ্বংস হচ্ছে লাখ লাখ রেণুপোনা। মাছ ধরতে ধরতেই এসব কথা বলছিলেন সুন্দরবনের সঙ্গে নাড়ির টানে বাঁধা আম্বিয়া খাতুন। এ নিবিড় সম্পর্কের মধ্যেই তারা ভালো থাকে।

আজ বিশ্ব ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বন দিবস। জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেসকোর উদ্যোগে ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছর ২৬ জুলাই দিনটি পালিত হয়ে আসছে। ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমস বা শ্বাসমূলীয় বাস্তুসংস্থানের টেকসই সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ইউনেসকো দিনটি বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন। একই সঙ্গে বন, জলাভূমি, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত এমন প্রাকৃতিক বন পৃথিবীতে দেখা যায় না। নজরকাড়া নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ বন সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। সারা দেশের মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীর আনুমানিক মোট প্রজাতি ১১ হাজার ৮০০টির মধ্যে সুন্দরবনেই আছে ২ হাজার ২০০। বৈশ্বিকভাবে বিপদাপন্ন ৩১টির বেশি প্রজাতি আছে এখানে। সুন্দরবনে মোট উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ৩৩৪। বিশ্বের মোট ৪৮ প্রজাতির শ্বাসমূলীয় বৃক্ষের মধ্যে সুন্দরবনেই রয়েছে ১৯টি। সুন্দরবনের প্রায় ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে। পৃথিবীর বেশির ভাগ ম্যানগ্রোভ বনে দুই থেকে তিন প্রজাতির শ্বাসমূল রয়েছে। আর সুন্দরবনে ছয় ধরনের শ্বাসমূল দেখা যায়, যা বনটিকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।

বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশের ঐশ্বর্য, মর্যাদা ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে সুন্দরবনের বড় ভূমিকা রয়েছে। অনন্য গুরুত্ব বিবেচনায় ‘কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস’ ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার জলাভূমি অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমিগুলোকে রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অসামান্য মূল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো এই বনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে।

২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০০৭ সালে সিডর, ২০২০ সালে আম্পান ও ২০২১ সালে ইয়াসের গতি, প্রাণহানি ও সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি সুন্দরবন কমিয়ে দিয়েছে। সুন্দরবনের এই ভূমিকার কথা সেখানকার বনজীবীদের মধ্যেও পাওয়া যায়। বেসরকারি সংস্থা ‘উন্নয়ন অন্বেষণে’র মাঠভিত্তিক গবেষণাকালে বনজীবী খলিল ঢালী বলছিলেন, সুন্দরবন না থাকলে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তাদের ঘরবাড়ির অস্তিত্বই থাকত না। বনের গাছাপালা ও জীবজন্তুর অনেক ক্ষতি হলেও বেঁচে যায় মানুষের জীবন ও জীবিকা।

‘বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যে’র ঝুঁকি

ভালোবাসা ও গর্বের এবং ক্রিকেট খেলায় এ দেশের শৌর্যবীর্যের প্রতীক সুন্দরবন নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে বড় ধরনের উৎকণ্ঠার শুরু। ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র ওই বছর জুলাই মাসে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি তোলে। একই বছর ডিসেম্বর মাসে তেলবাহী জাহাজডুবির ঘটনার পর সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে অবৈধ নৌপথ নিয়ে আপত্তি ওঠে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনে রামপালসহ অন্যান্য প্রকল্পের প্রভাব খতিয়ে দেখতে একটি মিশন পাঠানোর ঘোষণা দেয় ইউনেসকো। ২০১৬ সালের আগস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্ব ঐতিহ্য ধরে রাখতে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবন থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া, ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সুন্দরবনে মিঠাপানির প্রবাহ বাড়ানো এবং সুন্দরবন ঘিরে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রসহ যেসব শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে, সে সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করার তিনটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।

সরকারের অনুরোধে সুন্দরবন ঘুরে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা ও নানা নথি পর্যালোচনা করে এ বছরের ১৬ জুন ইউনেসকোর ‘রিঅ্যাকটিভ মনিটরিং মিশনের’ এক প্রতিবেদনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বন্ধ রাখা, কোনো ভারী শিল্পকারখানার অনুমোদন না দেওয়া এবং ইতিমধ্যে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাগুলোর প্রভাব মূল্যায়নবিষয়ক সমীক্ষার শর্ত দেওয়া হয়েছে। তবে সুন্দরবনকে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্য বা লাল তালিকাভুক্ত করা হবে কি না, সে বিষয়ে আগামী বছর ইউনেসকোর সভায় সিদ্ধান্ত হবে। এর আগে ২০১৯ সালে কমিটির ৪৩তম সাধারণ সভায় সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রাখতে ৯টি শর্ত দেওয়া হয়েছিল।

কমছে সবুজের বিস্তার ও ঘনত্ব

ষোড়শ শতাব্দীতে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরি বইয়ে কুষ্টিয়া ও যশোর পর্যন্ত সুন্দরবনের বিস্তৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। ১৭৭৬ সালে বাংলাদেশ অংশের বিস্তার ছিল ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। ২০১৬ সালের এক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ অংশের বিস্তার ৬ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার।

বনে গাছপালার পরিমাণ মারাত্মকভাবে যে কমে গেছে, তা বনজীবী রজব সরদারও মনে করেন। তাঁর ভাষ্য, চারপাশে গাছপালা দেখা গেলেও ভেতরে ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে ফাঁকা বা সামান্য গাছপালা দেখা যায়।

‘উন্নয়ন অন্বেষণে’র গবেষণা অনুযায়ী, খুলনার কয়রা অঞ্চলের নির্দিষ্ট এলাকায় দুই দশকে (২০০০-২০) বনের ঘনত্ব কমেছে প্রায় অর্ধেক। প্রথম দশকে (২০০০-১০) ব্যাপক হারে ঘন বন উজাড় হয়ে কমতে থাকে বনের বিস্তার। এ সময়ে পতিত জমি বৃদ্ধির হার তুলনামূলক কম থাকলেও পরবর্তী দশকে (২০১০-২০) প্রায় দ্বিগুণ হারে খালি বা পতিত জমির পরিমাণ বেড়েছে। অন্য এক হিসাবে রামপাল কয়লাভিত্তিক প্রকল্প এলাকায় মাত্র সাত বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার একর বালু দিয়ে ভরাট করে ধূসর ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে।

হুমকিতে প্রাণবৈচিত্র্য

আইইউসিএনের হিসাব অনুযায়ী, মোট ৪০টির বেশি প্রজাতির উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীকে মহাবিপন্ন বা সংকটাপন্ন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সুন্দরবনে বিপদগ্রস্ত বন্য প্রাণী প্রজাতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত—বেঙ্গল টাইগার, অজগর, রাজগোখরা, অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক পাখি বা হাড়গিলা, সাদা পেটের সমুদ্র ইগল, দুই প্রজাতির উদ্‌বিড়াল, মাসকেড ফিনফুট বা কালামুখ প্যারাপাখি, রিং লিজার্ড, মেছো বাঘ, স্যান্ডপাইপার বা চামচঠুঁটো বাটান পাখি, ইগল এবং লেজার অ্যাডজুট্যান্ট বা মদনটাক পাখি। বৈশ্বিকভাবে বিলুপ্তপ্রায় বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ সুন্দরবনে পাওয়া গেলেও এখন বিপন্ন। এ ছাড়া গাঙ্গেয় ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন এবং লোনাপানির কুমির প্রজাতিও বিপন্ন। বর্তমানে লোনাপানির কুমির আছে মাত্র ১৯০টি, ইরাবতী ডলফিন ২০০টি এবং গাঙ্গেয় ডলফিন ১৬০টি। এ ছাড়া গত চার দশকে সুন্দরবন থেকে মাছ উৎপাদন কমেছে প্রায় ৫৬ শতাংশ।

সুন্দরবনের পাশের একটি গ্রামের হাসুবিবির অভিজ্ঞতাতেও ওই চিত্রের সাক্ষ্য মেলে। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় এই নদীতে (শাখবাড়িয়া নদী) কুমির ভাসতে দেখেছি। শুশুক দেখা যেত। সব হারায়ে গেছে।’

সুন্দরবন ও দক্ষিণ উপকূলের নদ-নদীতে মৃত ডলফিন (শুশুক) ভেসে আসছে। ডলফিনের শরীরে জখমের চিহ্নও দেখা যায়। কুদ্দুস ঢালী বলছিলেন, ‘আগে অনেক শকুন, ইগল দেখতাম বনে। এখন কালেভদ্রেও এগুলো দেখা যায় না।’

বন থেকে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, মাছের রেণু ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বেশি পরিমাণ আহরিত হচ্ছে। পানিতে বিষ দেওয়ায় ও ঘন জাল ব্যবহার করে মাছ ধরায় জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে নানা জলজ জীব। বিস্তার ক্রমশ ছোট হয়ে আসায় অনেক উদ্ভিদ প্রজাতির পরিমাণ কমছে। সবচেয়ে বেশি চলে যাচ্ছে সুন্দরীগাছ। বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষে মাটিতে লবণাক্ততার আগ্রাসনে সুন্দরীর মতো কম লবণসহিষ্ণু গাছ মরতে বসেছে।

আন্তদেশীয় নদীতে উজানে বাঁধ নির্মাণে ভাটির নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ কমে পলি জমে ও ভরাট হয়ে সুন্দরবনের ভূমির উচ্চতা দেড় থেকে দুই ফুট বাড়ায় জোয়ারের পানি আসতে পারছে না। পাতা ও গুল্মের পচন না হওয়ায় শুকিয়ে এখন অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। গত দুই দশকে আগুন লেগেছে প্রায় ২৪ বার এবং অন্তত ৮২ একর বনভূমির গাছপালা পুড়েছে।

হারিয়ে যাওয়া চকরিয়া সুন্দরবন

কক্সবাজারের চকরিয়ায় ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সুন্দরবন। প্রাথমিকভাবে আয়তন ৪৫ হাজার ৫০০ একর থাকলেও পরবর্তী সময়ে সরকার বেশ কিছু অংশ কৃষিজমির জন্য বন্দোবস্ত করলে আয়তন দাঁড়ায় ২১ হাজার একর। এখন অস্তিত্ব নেই।

সম্প্রতি এখানে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে বনটি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকার নদী ও সাগরের মোহনায় জেগে ওঠা নতুন চরে বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক বনভূমিতে সাফারি পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে।

সুন্দরবনের মৌয়ালরা এপ্রিল, মে ও জুন মাসে মধু সংগ্রহ করতে বনে যান। সুন্দরবনে আমার এক গবেষণার সময় কথা হয় খলিল ঢালীর সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁরা মৌচাকের একটি নির্দিষ্ট অংশ (প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ) কেটে বাকি অংশ পরবর্তী প্রজননের জন্য রেখে দেন। ধাতব সরঞ্জাম ব্যবহার না করে হাত দিয়ে এবং আগুন না লাগিয়ে শুধু শুকনা পাতা দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করায় অল্প বয়স্ক মৌমাছি মারা যায় না এবং মৌচাকটি পুনরায় ব্যবহার করা যায়।

গোলপাতা সংগ্রহকারীরা বছরে একাধিকবার একই অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেন না। পাতা প্রায় ৯ ফুট লম্বা হলেই কাটেন। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন গোলপাতা জন্মানোর সময় সংগ্রহ করেন না। কচি গাছ কাটা হয় না। এমনভাবে কাটেন, যাতে গাছের কেন্দ্রীয় পাতা এবং তার পাশের পাতার কোনো ক্ষতি না হয়।

বনজীবী হাবিবুর রহমান গাজীর ভাষ্য, তাঁরা হাত দিয়ে জাল বোনেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম জাল দিয়ে মাছ ধরেন। হাতে বোনা জালে ছোট মাছ, রেণু বা ডিম নষ্ট হয় না। কিন্তু কারেন্ট জাল, বাইনজালে ছোট মাছ, রেণু মারা পড়ে। বহিরাগতদের এসব প্রথাগত কৌশল জানা থাকে না। মুনাফা লক্ষ্য হওয়ায় বহিরাগতরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে।

লোকজ এবং প্রথাগত জ্ঞান ব্যবহার করে কমিউনিটিভিত্তিক মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, শামুক এবং উদ্ভিদের সমন্বিত চাষব্যবস্থা উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অত্যন্ত উপযুক্ত। এ প্রক্রিয়া বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষের চেয়ে টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং লাভজনক।

সংরক্ষণে সম্মিলিত সহব্যবস্থাপনা

সরকার সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্য ও চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, এসব এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন নিষেধ রয়েছে। কিন্তু সেখানে কারখানা স্থাপন থামানো যাচ্ছে না।

সরকারিভাবে দেশের ৪১টি এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। ২২টি সংরক্ষিত এলাকায় স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে সহব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে সরকার, স্থানীয় জনগণ এবং আইইউসিএনের মতো বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাঘ, ঘড়িয়াল, ডলফিন, শকুন ইত্যাদি প্রজাতি সংরক্ষণে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া গেলে বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।

বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ২০২০-পরবর্তী জীববৈচিত্র্য কাঠামো ও সামাজিক স্বাধীনতা

বিদ্যমান বন আইন ঔপনিবেশিক। মোদ্দা কথা, সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আয়। কিন্তু স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং লোকজ ও প্রথাগত জ্ঞানকেন্দ্রিক টেকসই ব্যবহার আইনের ভিত্তি হওয়া জরুরি। বন আইন, ২০১৯ খসড়ায় বিভিন্ন দিকের ওপর মতামত চাওয়া হয়েছে। আইইউসিএন বাংলাদেশ জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে মতামত ও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের টেকসই পুনরুদ্ধারে নতুন সুনির্দিষ্ট পথনকশা নির্ধারণ দরকার। ২০২০-পরবর্তী নতুন জীববৈচিত্র্য কাঠামো নির্ধারণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই অভীষ্ট অর্জনে ও বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার দশকে দেশের মোট স্থলভূমির ৩০ শতাংশ এবং জলভূমির ৩০ শতাংশের (৩০:৩০:৩০) সংরক্ষণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

স্থানীয় জনগণের কাছে সুন্দরবন এক নৈসর্গিক জীবন্ত সত্তা। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে আন্তসম্পর্ক, পরস্পরনির্ভরশীলতা ও সহযোগিতার আধার ও আধেয়। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কৃত্রিম সীমানা নির্ধারণ নয়, বরং মানুষ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যকে তার নিজের আবহে ভালো থাকাই সামাজিক স্বাধীনতা। সামাজিক স্বাধীনতা লালনের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং মানুষ ও পরিবেশ উভয়েরই ভালো থাকা নিশ্চিত হবে।

* ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন। আইইউসিএন এশিয়া আঞ্চলিক মেম্বার্স কমিটির ভাইস চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশের আইইউসিএন জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন।