ঝুঁটি শালিক

মা ঝুঁটি শালিক ও তার ছানা। ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তোলা ছবি l লেখক
মা ঝুঁটি শালিক ও তার ছানা। ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তোলা ছবি l লেখক

‘সন্ধ্যা হয়—চারদিকে মৃদু নীরবতা;

কুটা মুখে নিয়ে এক শালিখ যেতেছে উড়ে চুপে’

 —জীবনানন্দ দাশ

 সুপারির বাগান। কয়েকটি গাছে একাধিক ফোকর। ফোকরগুলো ১০ বছর পর্যন্ত দখল করে রাখছে ঝুঁটি শালিকেরা, যেন নিজের কেনা বাড়ি। কারও সাধ্য নেই ওদের তাড়ানো। দোয়েল ও প্যাঁচা ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে অনেকবার। বনের মধ্য দিয়ে একটি গুইসাপ যাচ্ছে। রক্ষা নেই, চেঁচামেচি শুরু। ইতিমধ্যে বনের অন্য পাখিরাও এসে গেছে। ঠোকর থেকে রেহাই নেই গুইসাপটির। কিছুক্ষণ পর সে পালাল।

গ্রামে পাখিরা কোলাহল করে গাছে গাছে। শালিকদের ডাক স্পষ্ট শোনা যায়। জীবনানন্দ দেখেছেন সন্ধ্যার নীরবতার সময় মুখে খড় নিয়ে শালিকদের উড়ে যেতে। সন্ধ্যায় ডাকাডাকি করে শালিক ওদের নিজস্ব এলাকার সীমানা ঘোষণা করে। তখন ডাক শুনে অন্য শালিকেরাও চলে আসে। কিছুক্ষণ পর এ কোলাহল থেমে যায়। অনেক প্রজাতির পাখি একসঙ্গে মিলে রাত কাটায়। পাখিদের ভয়ের সময়টা হলো রাত। অনেক প্রজাতির পাখি একসঙ্গে থাকলে বিপদ ঘটার আশঙ্কা কম থাকে।

প্রধানত ছোট-বড় জঙ্গলই ঝুঁটি শালিকের প্রিয় আবাস। লোকালয়ের আশপাশ ও ধানখেত চষে বেড়ায় খাবারের খোঁজে। বিপদের আঁচ পেলেই কেটে পড়ে ঝোপের গহনে। গ্রামের খোলামেলা মাঠ, শস্যখেতের ধার, বন-জঙ্গলে এ পাখি বিচরণ করে। দলে কখনো ১০ থেকে ২০টি পাখি থাকে। আর্দ্র স্থান বেশি পছন্দ। এ পাখির জোড়াদের মধ্যে অনেক দিন সম্পর্ক থাকে। ভাত ও গো-শালিকদের সঙ্গে এদের বন্ধুত্ব বেশি। গরু, মোষের পিঠে পোকার জন্য বসে থাকে ঝুঁটি শালিক।

বরিশালে কোনো কোনো গ্রামে পাখিটিকে চন্দনা শালিকও বলে। মাথা কালো। শরীরের রং কালচে বাদামি। লেজের ওপরের পালক ছাই-ধূসর ও পাটকেল রঙের। লেজের তলার পালক সাদা। ঠোঁটের আগা কমলা হলুদ, পা হলদেটে, চোখের চারপাশ লাল। প্রজননের সময় ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই মাস। প্রজননকালে গাছে বসে একে অপরকে গলা উঁচিয়ে আদর করে, কথা বলাবলি করে। বাসা বাঁধা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধে। তার কারণ হলো ফোকরের সংখ্যা কম। তাই ফোকর দখল করার জন্যই ঝগড়া। টিয়েদের বাসা দখলের জন্য চেষ্টা করে, কিন্তু পেরে ওঠে না ওদের ধারালো ঠোঁটের সঙ্গে। মাঝে মাঝে ওদের দলের অন্য শালিকেরা এসে বাসার ডিম ফেলে দেয়, এমনকি বাসার খড়কুটোও। মজার ব্যাপার হলো, এ পাখি অন্য শালিকদের বাসা থেকে লতাপাতা নিজের বাসায় নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে পেঁচারা ওদের বাসা দখল করে নেয়।

সরু ডাল, খড়-কুটা, শিকড়, ঘাস, পাখির পালক, সাপের খোলস ও পুরোনো কাপড় দিয়ে বাসা তৈরি হয়। বাসা বানাতে ছয় থেকে সাত দিন সময় লাগে। সুপারি, রেইনট্রি, আমড়া, হিজল ইত্যাদি গাছের ফোকর বেশি পছন্দ। তিন থেকে ছয়টি চকচকে নীল রঙের ডিম পাড়ে। দুই পাখি মিলেই সংসার করে এবং পালা করে ডিমে তা দেয় ১৫ থেকে ২০ দিন। ছানা ফুটলে দুজনেই খাবার খাওয়ায়। ছানারা একটু বড় হলে ফোকরের মুখের কাছে চলে আসে। রি...জি, রি..ঝি..করে ডাকে। ২০ থেকে ২৭ দিনে উড়তে শেখে। ছানারা উড়তে শিখলে মা-বাবার সঙ্গে বের হয় খাবারের খোঁজে। খেজুরের রস, বট, জাম, পাকুড়, পাকা খেজুর ও কীটপতঙ্গ খায়।