দুর্লভ পাখি খোয়াজ

ফেনীর মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকায় খাবার খোঁজায় ব্যস্ত খোয়াজ
ছবি: লেখক

পক্ষী আলোকচিত্রী সাজ্জাদ খানকে সঙ্গে নিয়ে দিনভর জিল্লাল মাঝির নৌকায় ঘুরেও সাদা-কালো উল্টো চঞ্চুর পাখিগুলোর দেখা পেলাম না। পরদিন আবারও রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে গেলাম। তবে ভাগ্য বেশ খারাপ।

পুরোটা নদী যেন কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে। নদীর পাড়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ১০টা নাগাদ নুরু মাঝির ছোট্ট ইঞ্জিন নৌকায় চাপলাম। কুয়াশা কেটে ধীরে ধীরে নৌকা এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ একটা বড় খোঁপাডুবুরি পানির ওপর দিয়ে যেন হেঁটে চলে গেল! বেশ কিছুটা এগোনোর পর ছোট্ট একটি চরে একজোড়া ভোঁদরের দেখা মিলল। ধীরে ধীরে নৌকা চর খানপুরে প্রবেশ করল।

আর সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল! নুরু মাঝিকে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করতে বললাম। এত খোঁজাখুঁজির পর শেষ পর্যন্ত পেলাম ওদের দেখা, একসঙ্গে ১৩টি পাখি। প্রথমবার ২০১৬ সালে দেখেছিলাম নিঝুম দ্বীপে। তবে ওদেরকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছি ফেনীর মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকায়।

সাদায়-কালোয় পাকড়া রঙের পাখিগুলোর দেহের বেশির ভাগ অংশই সাদা। কিন্তু কপাল, মাথার চাঁদি থেকে চোখের নিচ, ঘাড়ের পেছন, কাঁধ ও ডানা-ঢাকনি এবং বাইরের ডানার প্রান্ত পালক কালো।

বসা অবস্থায় ডানা ও পিঠে তিনটি কালো ফিতার মতো চোখে পড়ে। স্ত্রী-পুরুষের পালকের রঙে পার্থক্য না থাকলেও আকারে স্ত্রী খানিকটা খাটো। অদ্ভুতভাবে ওপরের দিকে বাঁকানো ৮-৯ সেমি লম্বা চঞ্চুটি পুরুষের তুলনায় স্ত্রীর ক্ষেত্রে বেশি বাঁকানো। চোখ লালচে বাদামি ও চঞ্চু কুচকুচে কালো। লম্বা পা ও পায়ের পাতা নীলচে ধূসর। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির কাঁধ ও ডানা-ঢাকনি ধূসর-বাদামি।

দেহের দৈর্ঘ্য ৪২-৪৬ সেন্টিমিটার (সেমি), প্রসারিত ডানা ৭৫-৮০ সেমি ও ওজন ২২৫-৩৯৫ গ্রাম। পাখিগুলো সচরাচর ছোট ও বিচ্ছিন্ন ঝাঁকে থাকে। চরের পাশের অগভীর পানিতে হেঁটে হেঁটে বা সাঁতরে লম্বা চঞ্চু দিয়ে এপাশ-ওপাশ করে পানি বা কাদায় খাদ্য খোঁজে। ছোট শামুক, কুঁচো চিংড়ি, পোকা ও জলজ উদ্ভিদ পছন্দ। জোয়ারের সময় বেলাভূমি, কাদাচর বা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে। সচরাচর তীব্র কণ্ঠে ‘ক্লু-ইট--ক্লু-ইট--ক্লু-ইট–––’ শব্দে ডাকে, বিরক্ত হলে তীক্ষ¥কণ্ঠে ‘কিউইট-কিউইট-কিউইট---’ শব্দে অবিরাম ডাকতে থাকে।

এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রজননকাল। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি প্রতি প্রজনন মৌসুমে নতুন করে জোড় বাঁধে। আবাসভূমির খাটো উদ্ভিদসম্পন্ন নোনা বাদায় উন্মুক্ত স্থানে বা শক্ত কাদার ওপর লতা-পাতা-ঘাস বিছিয়ে বাসা বানায়। একসঙ্গে দল বেঁধে ১০-৭০ জোড়া পাখি মিলে কলোনি তৈরি করে থাকে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি, রং কালচে বা খয়েরি ছিটসহ বাদামি-সাদা। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই তা দেয়, ডিম ফোটে ২৩-২৫ দিনে। সদ্য ফোটা ছানাগুলোর দেহের কোমল পালকের রং রুপালি-ধূসর। ছানারা ৩৫-৪২ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল ৮-৯ বছর।

সাদা-কালোয় অনিন্দ্যসুন্দর ও দুর্লভ এই জলজ পাখির নাম খোয়াজ। ঢেঙ্গা, চ্যাঙ্গা, চরখুঁচি বা লাঙল পাখি নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে কুশিয়াচাহা। ইংরেজি নাম পাইড অ্যাভোসেট, ব্ল্যাক-ক্যাপড অ্যাভোসেট, ইউরেশিয়ান অ্যাভোসেট বা অ্যাভোসেট। গোত্র রিকার্ভিরস্ট্রিডি, বৈজ্ঞানিক নাম Recurvirostra avosetta। ইউরোপ, আফ্রিকা, সাইবেরিয়া, মধ্য এশিয়া ও মঙ্গোলিয়ার এ পাখিগুলো শীতে পরিযায়ী হয়ে এ দেশের উপকূলীয় ও বড় নদীতে আসে।

আ ন ম আমিনুর রহমান, অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর