ধূসর–মাথা হট্টিটি

বর্ণি বাঁওড়ে পাখি বিক্রেতার হাতে ধরা সেই ধূসর–মাথা হট্টিটি
ছবি: এম এ সাদেক

গোপালগঞ্জের বিখ্যাত বর্ণির বাঁওড় এলাকায় একটি জরুরি গবেষণাকাজে গেছেন প্রাণিবিজ্ঞানী মোহসিনুজ্জামান চৌধুরী, এম এ সাদেকসহ আরও দুজন। তিন দিন ছিলেন তাঁরা মৎস্য অধিদপ্তরের রেস্টহাউসে।

এক সকালে খবর পেলেন তাঁরা–বর্ণি বাজার ও আশপাশে সদরে-গোপনে নানান রকম শীতের পরিযায়ী পাখিসহ দেশি পাখি বিক্রি হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলেন। রেস্টহাউস থেকে বাজারটা বেশ কিছুটা দূরে। ওখানে পৌঁছানোর আগেই পাখি বিক্রেতারা সরে পড়ে, একজনকে পান তাঁরা যার এক হাতে তিন–চারটি ধূসর টিটি, অন্য হাতে কয়েক প্রজাতির ‘খেনি’ ও একটি মাত্র কালিম পাখি। বিক্রেতা কে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে একে একে সব কটি পাখির পায়ের বাঁধন খুলে মোহসিনুজ্জামান ও এম এ সাদেকের হাতে দিল।তারা পর্যায়ক্রমে পাখিগুলোকে অবমুক্ত করলেন।

বিক্রেতার কাছ থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করার পরে যখন সবাই ফিরবেন আবার রেস্টহাউসে, তখন পাখি বিক্রেতা আঞ্চলিক ভাষায় যা যা বলল, তার অনুবাদ হচ্ছে, ‘স্যাররা! এই যে পাখিগুলো ছেড়ে দিলেন আপনারা, তাতে লোকসান হলো আমার, আপনাদের বা পাখিগুলোরও লাভ হলো না কিছু। এই পাখিগুলো পেটের দায়ে আবারও নামবে বাঁওড়ে, আবারও পড়বে জাল-ফাঁদে, আবারও আসবে আমাদের মতো খুচরা বিক্রেতাদের হাতে। আমরা তো পাখির আড়ত থেকে কিনে আনি, খুচরা বিক্রি করি। মূল জায়গায় তো আপনারা কিছু করতে পারবেন না, পারবেন?’

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। ‘পাখির আড়ত’ কথাটাও অনেকের কাছে অজানা। গত ৬০ বছরের অভিজ্ঞতায় ‘পাখির আড়ত’ সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে। এই তো গত ২ জানুয়ারি ২০২১ বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার একটি গ্রামে ৭০০ থেকে ৮০০ শালিকের একটি আড়ত থেকে বন বিভাগ সব কটি শালিককে অবমুক্ত করেছে। এগুলো ‘কথা বলা পাখি’ হিসেবে বিক্রি করা হতো।

বর্ণি বাঁওড়! সত্তর দশক থেকে নব্বই দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত বর্ণি বাঁওড়, পিঠাবাড়ি পাথার, কোটালীপাড়া উপজেলার তেঁতুলবাড়ী বিল, জলেঙ্গার বিল, টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাথরঘাটা বিল, টুঙ্গিপাড়ার খোট, মকসুদপুর উপজেলার চান্দার বিল, কাশিয়ানী উপজেলার সিংগাবিল, ওড়াকান্দিসহ অন্তত আরও ২০টি বিলে আমি ঘুরেছি বেশ কিছুবার। গত ৫০ বছরে পরিযায়ী পাখি কমেছে, বিক্রি আজও হচ্ছে।

তো ওই দিন অবমুক্ত করা পাখিগুলোর মধ্যে ছিল ধূসর টিটি বা ধূসর–মাথা হট্টিটি। শীতের পরিযায়ী এই পাখির দেখা মেলে সারা দেশে। তবে সংখ্যায় কম। হাওর-বাঁওড়ের জল নয়, জলের কিনারে বা খোলা জায়গায় হেঁটে হেঁটে খায় কাদামাটির ভেতরে থাকা ও জলজ পোকামাকড়, কেঁচো ও কেঁচোজাতীয় প্রাণী ইত্যাদি। ছোট দলে বা বড় ঝাঁকে চলে। মাটির ওপর দিয়ে হাঁটে এরা দাপটের সঙ্গে। তালে তালে পা ফেলে ছন্দে ছন্দে হাঁটে প্রশিক্ষিত সৈনিকদের মতো। ঝাঁক ধরে ওড়ার পরে যখন দিক বদল করে, তখন আশ্চর্য-সুন্দর ডিসপ্লে তৈরি হয়ে যায়। ছাই-বাদামি মাথা-ঘাড়-গলা, গলার নিচের বুকে আড়াআড়ি চওড়া কালো ব্যান্ড, চকচকে বাদামি পিঠ, লেজের আগা কালো, তুলোট সাদাবুক, ঠোঁট ও পা টকটকে হলুদ। সব মিলে খুব সুন্দর এই হট্টিটির ইংরেজি নাম Grey-headed Lapwing। বৈজ্ঞানিক নাম Vanellus cinereus। দৈর্ঘ্য ৩৭ সেন্টিমিটার।

শরীফ খান : পাখি ও বন্য প্রাণিবিষয়ক লেখক