নাম তার সাগরদিঘি

হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে ঐতিহ্যবাহী সাগরদিঘিছবি: প্রথম আলো

চারদিকে সবুজ বেষ্টনী। মাঝখানে বিশাল এক দিঘি। দেখতে অনেকটা সাগরের মতো। নাম তাই সাগরদিঘি। আবার কারও কাছে ‘কমলারানীর দিঘি’ এবং ‘কমলাবতীর দিঘি’ হিসেবেও পরিচিত।

এ দিঘির স্বচ্ছ জলে ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর সূর্যের আলো নেচে বেড়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন ছোট ছোট প্রদীপ ভাসছে। বর্ষায় এর ঝলমলে রূপ আরও দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে।

সাগরদিঘির চারপাশের পাড়কে ঘিরে একেকটি গ্রাম গড়ে উঠেছে। পূর্ব পাড়ে পূর্বপাড় গ্রাম। পশ্চিম পাড়ে এল আর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও বিশাল সবুজ মাঠ। স্কুলের ঠিক দক্ষিণেই ‘লাউড় রাজ্যে’র সময়কার স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ, পুরাকৃর্তি পাথরের দাড়া-গুটি। উত্তর পাড়ে উত্তরপাড় গ্রাম ও মাদারিঢোলা গ্রাম। দক্ষিণে দক্ষিণপাড় গ্রাম।

দিঘিটি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলা সদরে অবস্থিত। জেলা সদর থেকে দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। যাতায়াতে সময় লাগে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। ৬৬ একরের এ দিঘি দেখতে দেশের নানা জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন। আয়তনের দিক থেকে দিঘিটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাধার হিসেবে স্বীকৃত।

বৃহদায়তনের এ জলাধার নিয়ে এলাকায় নানা আলোচনা আছে। দ্বাদশ শতাব্দীতে সামন্ত রাজা পদ্মনাভ প্রজাদের জলকষ্ট নিবারণের জন্য এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচংয়ের মধ্যভাগে এ বিশাল দিঘি খনন করেন। এ দিঘি খননের পর পানি না ওঠায় স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজা পদ্মনাভের স্ত্রী রানি কমলাবতী এ দিঘিতে নিজেকে বিসর্জন দেন বলে একটি উপাখ্যান প্রচলিত আছে। এ জন্য এ দিঘিকে কমলারানীর দিঘিও বলা হয়ে থাকে।

এ দিঘির কাহিনি নিয়ে বাংলা ছায়াছবিসহ রেডিও মঞ্চনাটক রচিত হয়েছে। পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীন বানিয়াচং পরিদর্শনকালে নয়নাভিরাম সাগরদিঘির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ‘রানি কমলাবতীর দীঘি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি তাঁর সূচয়নী কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দিঘিটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দিঘি হিসেবে খ্যাত। (সূত্র: জেলা প্রশাসনের পাহাড় টিলা হাওর বন পর্যটনবিষয়ক প্রকাশনা)

দিঘিটি এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৬ সালে পুনঃখনন করান তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী সিরাজুল হোসেন খান। দিঘিটি বর্তমানে সরকারের অনুকূলে থাকলেও দিঘির চার পাড়ের বাসিন্দারা এটিতে মৎস্য চাষ করে ভোগদখল করছেন। তবে স্থানীয় লোকজন এ দিঘিকে সংস্কার করে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্তের দাবি তুলেছেন।

বানিয়াচংয়ের বাসিন্দা ও জনাব আলী কলেজের শিক্ষার্থী সুমন দাশ বলেন, ‘বানিয়াচং একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ। কিন্তু সে ঐতিহ্য সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা বা কোনো উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ছে না।’ প্রায় একই অভিমত ব্যক্ত করেন তাঁর সঙ্গে থাকা একই কলেজের ছাত্র ফয়সল আহমেদ। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, সাগরদিঘির তিন পাড়ের তীর অনেকটাই দখল হয়ে গেছে। একই সঙ্গে লাউড় রাজ্যের সময়কার স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ, মোগল আমলের স্থাপত্যকীর্তির মসজিদ, পাথরের দাড়া-গুটি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকলেও সেসব সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই।

বানিয়াচং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম চৌধুরী জানালেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে বানিয়াচং সফরে এসে এক জনসভায় সাগরদিঘিকে ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এলাকাবাসী এখনো মনে করেন, এ প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হবে।

প্রশাসন থেকে এ দিঘিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সম্প্রতি পর্যটন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানালেন বানিয়াচং ইউএনও মাসুদ রানা। এ ছাড়া সম্প্রতি বানিয়াচং সফরে এসে দিঘি পরিদর্শন করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। এলাকাবাসীর আশা, পর্যটনকেন্দ্র করার মধ্য দিয়ে সাগরদিঘির ঐতিহ্য রক্ষা পাবে।