পাখির নাম নীলকণ্ঠ

নীলকণ্ঠের ছবি পঞ্চগড় থেকে তুলেছেন আ ন ম আমিনুর রহমান।

চৈত্র মাস। বিশাল মাঠটি একেবারেই শুকনো। জায়গায় জায়গায় তাল-খেজুরগাছ। জমিগুলোর সীমানাজুড়ে সারি সারি জিকলগাছ।

মরা একটি তালগাছের মাথার নিচের গর্তের বাসা থেকে বেরিয়ে তিনটি নীল রঙের পাখির বাচ্চা বসেছে গাছটির মাথায়, গাদাগাদি করে। দু-চার দিনের ভেতর উড়তে শিখবে ওরা।

মা-বাবা পাখি মাঝেমধ্যেই এসে খাবার খাইয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাগুলো দারুণ চেঁচামেচি করে আর ডানা ঝাপটিয়ে খাবার নিচ্ছে মুখে।

তিনজন বালক এল মাঠটিতে। ওরা যে ফাঁদটি পাতল মাটিতে কাঠি পুঁতে, সেটার নাম ‘তেকাঠির ফাঁদ’। বাঁশের তিনটি মোটা শলাকায় ওরা একধরনের পরগাছার ফলের আঠা আচ্ছামতো মেখে দিয়েছে। ফলগুলো ওরা সেদ্ধ করেই আঠাটা ঘন করেছে। এ আঠা আইকার চেয়েও ভয়ংকর। তিনটি কাঠির গোড়া ওরা পুঁতল ত্রিকোণ করে। তারপর তিনখানা কাঠির মাথা এক জায়গায় এনে বেঁধে দিল সুতা দিয়ে। কাঠির পিরামিড যেন! তারপর তিনটি কাঠির মাথার দিকে আরেকটি সুতা ঝুলিয়ে দিয়ে সুতার নিচের দিকে কায়দা করে গেঁথে দিল একটি জীবন্ত তেলাপোকা। তারপর তিনজনে সরে গিয়ে বসল একটা খেজুর চারার আড়ালে। দেখতে না দেখতে মা বা বাবা পাখিটার নজরে পড়ল ছটফটরত তেলাপোকাটি, অমনি যেন মাথা গেল খারাপ হয়ে; ঝড়ের বেগে নেমে এসে যেই–না ধরতে গেছে তেলাপোকাটি, অমনি মস্ত দুই পাখা ও বুক-গলায় লেগে গেল আঠা। হায় রে ছটফট আর চেঁচামেচি! ওটার সঙ্গীও ধেয়ে এল চেঁচিয়ে মাঠ ফাটাতে ফাটাতে, ততক্ষণে তিনজন বালক গিয়ে পাকড়াও করেছে ফাঁদে আটকা পাখিটিকে। মাংস খাবে।

এ ঘটনা বাগেরহাট অঞ্চলের, সময়কাল আশির দশক। আর গত বছরের মার্চে আমি ফকিরহাট-মোল্লাহাট, খুলনার রূপসা উপজেলা ঘুরে মাত্র সাতটি পাখি দেখি। শুকনো মাঠ এখন আর নেই। নেই মরা খেজুর-তাল-নারকেলগাছ। তেকাঠির ফাঁদ পাতার সময়ও হয়তো আজকাল নেই কোনো দুরন্ত বালকের। এখন এদের শিকার করে এয়ারগানধারী ও পয়েন্ট বাইশ বোর রাইফেল শিকারিরা। নির্বিচার শিকার হচ্ছে ঘুঘু, মাছরাঙাসহ নানান রকম পাখি। খুলনা-বাগেরহাটে এ শিকারিদের প্রতাপ-দাপট ও শিকার বেশি। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে পাখি মারা নিষিদ্ধ। তাহলে মানুষের হাতে কেন এ অস্ত্র?

কারণ-অকারণে সার্বক্ষণিক টেনশনে ভোগা ও চিৎকার-চেঁচামেচিতে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পাখিটির নামটিও কাব্যিক—নীলকণ্ঠ। এরা মূলত খোলা জায়গার পাখি। উঁচু জায়গায় বসে থাকে চুপচাপ নজর ঘোরায় চারপাশের মাটিতে। প্রখর দৃষ্টিশক্তির আওতায় পোকামাকড়, টিকটিকি, চিলুসাপ, গিরগিটি, কেঁচো ইত্যাদি পড়লেই ডাইভ দিয়ে গিয়ে নামবে মাটিতে। ঘাসফড়িং, ইঁদুরছানা, তেলাপোকা, ঘুগরা পোকা ও ঝিঁঝি পোকা দেখলে এদের মাথা যেন খারাপ হয়ে যায়। অতি প্রিয় খাবার যে! খায় ব্যাঙের ছানা, গিরগিটি ও সদ্য ডিম ফুটে বেরোনো কচ্ছপছানা।

জোড়ায় জোড়ায় থাকে, এক মাঠে দুই জোড়া নীলকণ্ঠ দেখা যাবে না সহজে। কেননা, নিজের এলাকাকে ওরা ‘বাবার তালুক’ বলে মনে করে।

পাখিটির সৌন্দর্য দেখলে মনে হয়, কোনো ধ্রুপদি শিল্পী মনের মাধুরী মিশিয়ে এদের শরীরে শিল্পিতভাবে নীল-হালকা নীল ও গাঢ় নীলের সমন্বয়ে দারুণ একটি ছবি এঁকেছেন। লালচে বাদামি গলা, চিবুক, বুক ও ঘাড়-পিঠ। লেজের নীল আর পাখার প্রান্তের উজ্জ্বল নীলটা যেন শূন্যে নীলাভ আভা ছড়ায়, যখন ওড়ে। উড়তে পারে দ্রুতবেগে, আস্তেও পারে, উড়তে উড়তে নানান রকম কসরতও দেখাতে পারে।

বাসা করার মৌসুম বসন্ত-বর্ষাকাল। ওই মৌসুমে দুটি পাখি মিলে প্রেমনৃত্য করে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে, এ সময় পাখা গুটিয়ে শূন্য থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়ার অভিনয়ও করে, শূন্যে দেখায় নানান রকম ডিসপ্লে ও অ্যাক্রোবেটিক শো। বাসা করে গাছের কোটরে-খোঁড়লে। ডিম পাড়ে তিন-চারটি। ছানা হয় ১৭-২০ দিনে। নীলকণ্ঠের ইংরেজি নাম Indian Roller। বৈজ্ঞানিক নাম coracias benghalensis। দৈর্ঘ্য ৩৩ সেন্টিমিটার। ওজন ১৬৫ গ্রাম। থোড়মোচা, কেওয়া, নীলাচল, নীলাঘুঘু ও নীলকবুতর নামেও ব্যাপকভাবে পরিচিত এরা।