পাহাড়ি ঝিরির ছোট্ট মাছরাঙা

উদয়ী বামনরাঙা মাছরাঙ্গা, খাগড়াছড়ির পাবলাখালী অভয়ারণ্যে
ছবি: লেখক

আট বছর আগের এক দুপুর। জুলাই মাসের প্রচণ্ড গরমের মধ্যে একটি পাহাড়ি ঝিরিপথে পাখি দেখার সন্ধানে হাঁটছি। খাগড়াছড়ি জেলার পাবলাখালী অভয়ারণ্যের গহিন জঙ্গলের একটি অতিপ্রাকৃতিক ঝিরিপথ এটি। এ অঞ্চলেই সবশেষ সত্তরের দশকে দেখা গিয়েছিল এ দেশের বিলুপ্ত পাখি বাদি হাঁস। ঝিরিপথে বিশেষ কোনো পাখি দেখার নেশায় আসিনি। পাহাড়ি এই পথটাই ছিল অনন্যসুন্দর। কোথাও হাঁটুপানি, আবার কোথাও কোমরপানি। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ঠান্ডা এই পানির পরশ বেশ ভালো লাগছিল। পুরো চার ঘণ্টা হেঁটে দেখা মিলেছিল মাত্র চার জাতের পাখির। এর মধ্যে সত্যিই একটি বিশেষ পাখি ছিল। নাম তার উদয়ী বামনরাঙা মাছরাঙা। ইংরেজিতে বলে ওরিয়েন্টাল ডোয়ার্ফ কিংফিশার। অসাধারণ ওই যাত্রায় দেখা হয়ে গেল এ দেশের সবচেয়ে ছোট মাছরাঙার সঙ্গে।

উদয়ী বামনরাঙা মাছরাঙার দৈর্ঘ্য মাত্র ১৩ সেন্টিমিটার। এই মাছরাঙা একটি হামিং বার্ডের চেয়ে কিছুটা বড়। এত ছোট পাখি হলেও পাখিটির হাঁকডাক কিন্তু খুব জোরালো। ডাক শুনে সহজেই উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট মাছরাঙাটি দেখা যায় আফ্রিকাতে। এটিও উদয়ী বামনরাঙা মাছরাঙা পরিবারেই সদস্য। মাছরাঙাটির নাম আফ্রিকান ডোয়ার্ফ কিংফিশার। এই মাছরাঙাটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ সেন্টিমিটার।

অতিবিরল উদয়ী মাছরাঙা এ দেশে খুব বেশি দেখা যায় না। মূলত পাখিটি গ্রীষ্মে বাংলাদেশে পরিযায়ী হয়ে আসে বাচ্চা ফোটানোর জন্য। নীরব পাহাড়ি ঝিরিতে এরা গর্ত করে বাসা বানায়। একসময় আমরা জানতামই না যে এ প্রজাতি আমাদের দেশে বাসা বানায়। এ দেশে মাছরাঙাটির প্রথম বাসা আবিষ্কার করেন গবেষক ও সহকর্মী তানিয়া খান। মৌলভীবাজারের আদমপুর পাহাড়ি এক ঝিরিতে তিনি ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম এক জোড়া মাছরাঙার সন্ধান পান। তার পর থেকে তিনি নিয়মিত ওই এলাকাতে যেতেন পাখিটির সন্ধানে। একই বছরের ২৫ মে তিনি ওই মাছরাঙার বাসা খুঁজে পান এবং ২৯ মে তিনি মাছরাঙাটির বাচ্চার ছবি তুলতে পারেন। এ জাতের মাছরাঙার বাচ্চার এটিই ছিল প্রথম ছবি। তার পর থেকে পাখি গবেষকেরা বুঝতে পারেন মাছরাঙাটি এ দেশে আসে বাচ্চা ফোটানোর জন্য।

উদয়ী বামনরাঙা মাছরাঙাকে পাবলাখালীর পর আরও দুই পাহাড়ি ঝিরিতে পেয়েছি। একবার লাউয়াছড়া আর সম্প্রতি মাসালং নদের ধারে। প্রতিবারই মাছরাঙাটিকে দেখেছি জুলাই মাছে। পাখিপ্রেমীদের কাছে এই মাছরাঙা অতি প্রিয়। বিরল বলেই হয়তো তার কদর বেশি। আর এত ছোট মাছরাঙাটির ছবি তোলাও খুব কঠিন। চোখের পলকে উধাও হয়ে যায়। তাই এই মাছরাঙার তথ্য খুবই কম আছে। ২০১২ সালের আগে মাত্র কয়েকটি পাখি দেখার তথ্য আছে লাউয়াছড়া আর সাতছড়ি বন বিভাগের কাছে। একটিমাত্র মাছরাঙা দেখার তথ্য আছে মধুপুর বন বিভাগের কাছে। সাধারণ পাহাড়ি বা মানুষের দৃষ্টিগোচর কম হয় বলেই তারাও পাখিটিকে কেউ চেনে না।

বাংলাদেশে ১২ জাতের মাছরাঙা দেখা যায়। এর মধ্যে দুটি মাছরাঙা পরিযায়ী। কালাটুপি মাছরাঙাটি এ দেশে আসে শীতে। সাধারণত সুন্দরবন ও উপকূলীয় এলাকায় বেশি দেখা যায়। অন্যটি হলো এই উদয়ী বামনরাঙা মাছরাঙা। গ্রীষ্মে পাহাড়ি বনে দেখা মেলে। পাহাড়ে মাছরাঙার প্রাচুর্য এমনিতেই কম। মূলত খাবারের অভাব। শীতে পাহাড়ি ঝিরিগুলো শুকিয়ে গেলে ছোট মাছসহ জলজ প্রাণী কমে যায়। বর্ষায় ঝিরিগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে। এ সময় ঝিরিগুলোতে উদয়ী বামনরাঙা মাছরাঙা পাখির ছোঁ মেরে মাছ ধরাসহ যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে পাখিপ্রেমীদের কাছে হাজির হয়।