প্রাণীর প্রতি অবহেলা সব সময়

সাফারি পার্কের বন্য প্রাণীর প্রতি নজর বাড়ানোর তাগিদ থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। প্রাণীর প্রতি অবহেলা আগেও ছিল।

গাজীপুরের শ্রীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে প্রায় এক মাসের ব্যবধানে ১১টি জেব্রার মৃত্যু হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের শ্রীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে প্রায় নিয়মিত বিরতিতে দেশি-বিদেশি বন্য প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রাণীর মৃত্যুর তথ্য গোপন করেছে। বন্য প্রাণীর যত্ন–আত্তিতে কর্তৃপক্ষের অবহেলার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে প্রায় এক মাসের ব্যবধানে ১১টি জেব্রা, ১টি বাঘ ও ১টি সিংহীর মৃত্যুর পরে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনার পর তাঁরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছেন। তবে সাফারি পার্কের একাধিক সূত্র বলেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটির সুপারিশ অবহেলা করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু হয় ২০১১ সালে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্কটি উদ্বোধন করেন। বর্তমানে পার্কটিতে প্রায় ৭৬ প্রজাতির ১ হাজার ৫০০ বন্য প্রাণী আছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন হাজার দর্শনার্থী পার্কে আসেন।

২০১৬ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজীপুর (তৃতীয় সংশোধিত) প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ একটি নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে সাফারি পার্কে বন্য প্রাণীর মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনে সিংহের ব্যাকটেরিয়াজনিত সেপটিসেমিয়া এবং বাঘের ভাইরাসজনিত রোগের কথাও উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্কে প্রাণীর বিচরণের জন্য পর্যাপ্ত স্থানের অভাব, অপর্যাপ্ত পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, অনিয়মিত টিকাদান, প্রাণীদের অসম যৌন অনুপাত, বন্য প্রাণী পরিচর্যা ও চিকিৎসার জন্য দক্ষ জনবলস্বল্পতা, উপযুক্ত চারণভূমি এবং প্রাকৃতিক খাবারের অভাব রয়েছে। এ বিবেচনায় এটি একটি বড়মাপের চিড়িয়াখানা, যেখানে খাঁচার পরিবর্তে বেষ্টনীর মধ্যে বন্য প্রাণী রাখা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বন্য প্রাণী লালন-পালনের জন্য একটি নির্দেশিকা প্রণয়ন এবং একটি বিধিমালা প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছিল।

ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনটি করা হয়েছিল একটি প্রকল্পকে সামনে রেখে। সে প্রকল্পটি শেষ হয়েছে।

দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল প্রসঙ্গে আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, নতুন জনবলকাঠামোর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে। বর্তমানে সাফারি পার্কে একজন ভেটেরিনারি সার্জন দায়িত্ব পালন করছেন। একজনের পক্ষে এত বড় দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব। নতুন জনবলকাঠামোতে তিনজন ভেটেরিনারি সার্জনের পদ রাখা হয়েছে। পার্কে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের জন্য চতুর্থ গ্রেডের একজন কর্মকর্তার কথা বলা হয়েছে। জনবলকাঠামো অনুমোদিত হলে পার্কের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।

এবার ১১টি জেব্রার মৃত্যুর ঘটনার পর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ডের পক্ষ থেকে জেব্রাসহ অন্যান্য প্রাণীর নিরাপত্তায় ১০টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

আগেও একাধিক মৃত্যু

সাফারি পার্কে চলতি বছরের ২ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে মোট ১১টি জেব্রার মৃত্যু হয়েছে। ৩১ সদস্যের জেব্রার পালে এখন আছে ২০টি। এ ছাড়া ১২ জানুয়ারি টাইগার বেষ্টনীতে ১০টি বাঘের মধ্যে একটির মৃত্যুর পর সদস্যসংখ্যা হয়েছে ৯। ল্যাব পরীক্ষায় মৃত বাঘের নমুনায় অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়া যায়। অপর দিকে ৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে রোগাক্রান্ত হয়ে একটি সিংহীর মৃত্যুর ঘটনার কথা জানিয়েছে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

২০১৩ সালে পার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঘ, জিরাফ, ক্যাঙারু, জেব্রাসহ বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। প্রাণীর মৃত্যুর পর পার্ক কর্তৃপক্ষ সব সময় তা গোপন রাখার চেষ্টাও করেছে। তবে গুইসাপ খেয়ে বাঘের মৃত্যু, নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ ও রোগাক্রান্ত হয়ে কয়েকটি জিরাফের মৃত্যু, গত বছর অতিরিক্ত গরমে একটি সাদা সিংহের মৃত্যু বা ২০১৭ সালের মে মাসে চার ঘণ্টার ব্যবধানে দুই জিরাফের মৃত্যুসহ বিভিন্ন মৃত্যুর ঘটনা গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। আলোচনায় আসার পর প্রতিবারই ঘটা করে তদন্ত কমিটি গঠনসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতাও পালন করা হয়েছে।

এক মাসের ব্যবধানে এতগুলো প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। এর মধ্যে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল কবির, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান ও বন্য প্রাণী চিকিৎসা কর্মকর্তা হাতেম জুলকারনাইনকে। বর্তমানে পার্কের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন ঢাকা বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়েছেন ফরিদপুরের সামাজিক বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া সেখানে ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের সদ্য বদলি হওয়া প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল কবির মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালে বন্য প্রাণীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। তবে এক মাসের মধ্যে ১১টি জেব্রা ও ১টি বাঘের মৃত্যুকে অবশ্যই ‘ব্যতিক্রম’ ঘটনা বলতে হবে।

জাহিদুল কবির বলেন, সাফারি পার্কে প্রাণীদের খাবারের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। খালি চোখে দেখে খাবারের মান নিয়ন্ত্রণ বা তাতে বিষ আছে কি না, তা বোঝা যাবে না। পার্কের ভেতরে খাবার পরীক্ষার কোনো ল্যাবরেটরিও নেই।

জাহিদুল কবিরের মতে, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা বন্য প্রাণীদের বাংলাদেশের আবহাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। জেব্রার কথা উল্লেখ করে জাহিদুল কবির বলেন, ২০১৫ সালের মধ্যে পার্কে জেব্রার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫। ২০১৯ সালের মধ্যে ১০টি জেব্রা মারা যায়। মূলত বাংলাদেশের পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার পর ২০১৮ সালের পর থেকে জেব্রাগুলো বাচ্চা দেওয়া শুরু করে।

বর্তমানে সাফারি পার্কে রাজস্ব খাত ও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মরত মোট জনবল ৬০–এর মতো। প্রাণীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজিস্ট, বন্য প্রাণীর স্বাস্থ্য এবং খাদ্যের মান ও পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বন্য প্রাণী পুষ্টিবিদ, শিক্ষা উপকরণ তৈরির জন্য এডুকেশন অফিসার বা কিউরেটরের পদ নেই পার্কে।

বন্য প্রাণীর নিরাপত্তায় সাফারি পার্কের চারদিকের সীমানাপ্রাচীর তৈরির বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয় ২০১৬ সালের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে। এতে পার্কের অবকাঠামো নির্মাণে ত্রুটিসহ বিভিন্ন দিকও তুলে ধরা হয়েছিল।