বাগডাশের সংসার

কালভার্টের ভেতরে গর্ভবতী বাগডাশ
ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান

করোনাকালের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ। বাসার চারদেয়ালে বন্দিজীবনের এক সপ্তাহ যেতে না-যেতেই বিশেষ দরকারে ডাক পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত ২৪ মার্চ সকালে গাজীপুর গেলাম। ক্যাম্পাসে পৌঁছেই ফাইলে ডুব। হঠাৎ বেসুরো শব্দে মোবাইলটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে পাখি দেখার নিত্যসঙ্গী কামালের সুমধুর আহ্বান। ওর চুম্বক আহ্বানে দ্রুত কেবিনেট খুলে ক্যামেরা নিয়ে ছুটলাম।

ঘাস চাষের জমিতে কামাল লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে শাটার রিলিজ বাটনে অর্ধেক ক্লিক করে ফোকাস করতেই চোখ ছানাবড়া। জমির এক কোণে ঘাসে আচ্ছাদিত বাসায় পাঁচ-পাঁচটি কালো কালো ছানা। গলায় সাদা মালা। চোখ না-ফোটা ছানাগুলোর বয়স বড়জোর দুই দিন হবে। গায়ে বড় বড় মাছি বসে আছে। কেমন খটকা লাগল। মরে যায়নি তো! ঠিক তক্ষুনি নড়েচড়ে ওরা জানান দিল, না, দিব্যি আছে।

দ্রুত পাঁচ-ছয়টা ক্লিক করলাম। কিন্তু ঘুমন্ত ছানাগুলোর মুখের ছবি ভালো এল না। হঠাৎ মা এসে ছানাগুলোকে বুকে টেনে নিল। আমাদের কারণে মা যদি ছানাগুলোকে ফেলে চলে যায়, সে কারণে ছবি না তুলেই নিঃশব্দে আমরা চলে এলাম। ছানাগুলোর নিরাপত্তাই আসল। গার্ডদের বলে দিলাম, ওদিকে যেন কেউ ঘাস কাটতে না যায়।

ক্যাম্পাসে আগেও বেশ কয়েকবার স্তন্যপায়ী বাগডাশ দেখেছি। তবে এতটা খুশি হওয়ার কারণ ঘটেনি। আগে অন্তত দুবার খবর পেয়ে গিয়ে চেষ্টা করেও মানুষের আঘাতে আহত প্রাণীগুলোকে বাঁচানো যায়নি, পারিনি। একবার শুধু খামারের মজুরদের রোষানল থেকে একটি গর্ভবতী বাগডাশকে ছাত্রদের সহযোগিতায় বাঁচাতে পেরেছিলাম। গৃহপালিত হাঁস-মুরগি মারার অপরাধে প্রাণীগুলো সারা দেশেই নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। সেখানে করোনাকালের নির্জনতায় ওদের বংশবৃদ্ধি হতে দেখে প্রাণী প্রজনন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কী আনন্দই না হচ্ছে!

ঘাসের জমিতে বাগডাশের চোখ না-ফোটা ছানা
ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান

বাগডাশের নানা নাম। বাঘডাশা, বড় খাটাশ, বাগখ্লাশ, বড় ভাম, হুইচা। ইংরেজি নাম লার্জ ইন্ডিয়ান সিভেট। Viverridae গোত্রভুক্ত প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Viverra zibetha

প্রাপ্তবয়স্ক বাগডাশের দেহ ৮০ থেকে ৮৬ সেন্টিমিটার দীর্ঘ। লেজ ৪৫ সেন্টিমিটার, উচ্চতা ৩৮ সেন্টিমিটার। ওজন ৫ থেকে ১১ কেজি। মাথা ও দেহ লম্বাটে। কালো পা খাটো ও শক্তপোক্ত। শরীর ধূসর কালো লোমে আবৃত। তার ওপর অসংখ্য কালো ফোঁটা ও ডোরা। গলার দুই পাশে তিনটি কালো ও দুটো সাদা ফিতার মতো থাকে। লম্বা লেজজুড়ে অনেকগুলো কালো ও সাদা বলয়। স্ত্রীর চেয়ে পুরুষটি আকার ও ওজনে কিছুটা বড়।

সুন্দরবন বাদে বাংলাদেশের সর্বত্রই বাগডাশ আছে। এরা নিশাচর ও ভূচারী। গাছে চড়তে ওস্তাদ। ঘাসবন, ঝোপঝাড়, ঘন বন, পরিত্যক্ত ইটভাটা, ঘরবাড়ি, পরিত্যক্ত গর্ত ইত্যাদিতে বাস করে। একই জায়গায় একসঙ্গে কয়েকটি পরিবার বাস করতে পারে। মূলত মাংসাশী এরা। সাপ, ব্যাঙ, ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, হাঁস-মুরগি-কবুতর, ডিম, মাছ ইত্যাদি খায়। প্রয়োজনে ফল, মূল, কীটপতঙ্গও খেতে পারে।

বছরে এরা দুবার ছানা তোলে। ৭০ থেকে ৮০ দিন গর্ভধারণের পর স্ত্রী তিন-চারটি ছানার জন্ম দেয়। বুনো পরিবেশে প্রায় ১৫ বছর এবং আবদ্ধ অবস্থায় ২০ বছর বাঁচে।

খাদ্য ও আবাস–সংকটে বাগডাশের অবস্থা করুণ। হাঁস-মুরগি-কবুতর খাওয়ার অপরাধে গ্রামাঞ্চলে মারা পড়ছে বেঘোরে। ধীরে ধীরে কমে গিয়ে এখন এরা বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় ঢুকে গেছে।