বাদাবনের রাজকাঁকড়া

জীবিত জীবাশ্ম রাজকাঁকড়া। এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চর থেকে তোলা
ছবি: লেখক

সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যানজটে পড়ে কক্সবাজার পৌঁছাতে বেলা একটা বেজে গেল। এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি। ফলে সোনাদিয়া যাওয়া আর হলো না। কিন্তু বাকি সময়টা তো কাজে লাগানো দরকার। গাইড গিয়াসউদ্দীনের সঙ্গে পরামর্শ করে দ্রুত দুপুরের খাবার সেরে স্পিডবোট নিয়ে মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চরের দিকে ছুটলাম। চরে পৌঁছেই যে যার মতো ছড়িয়ে পড়লাম নতুন পাখির সন্ধানে। ঘণ্টাখানেক পর আলোকচিত্রী আফজাল হোসেন খানের বন্ধু নজরুল ইসলামের সংকেত পেয়ে ওর দিকে গেলাম। কাছাকাছি আসতেই সে বলল, ‘স্যার, কচ্ছপের মতো এটা কী?’ কাদাপানিতে পড়ে থাকা প্রাণীটিকে দেখামাত্রই আনন্দে ফেটে পড়লাম। এ তো এক জীবিত জীবাশ্ম! পাখি খুঁজতে এসে এমন প্রাণীর দেখা পাব ভাবতেই পারিনি।

তাজিয়াকাটা চরের জীবিত জীবাশ্মটি এ দেশের সংকটাপন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণী রাজকাঁকড়া। ইংরেজি নাম ম্যানগ্রোভ হর্স-সু ক্র্যাব। নামে কাঁকড়া হলেও আদলে এটি কাঁকড়াবিছা ও মাকড়সার নিকটাত্মীয়। ম্যালকস্ট্রাকা শ্রেণির সন্ধিপদী প্রাণীটির গোত্র লিমুলিডি; বৈজ্ঞানিক নাম Carcinoscorpius rotundicauda। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে বাস করে এ প্রাণী। অতিরিক্ত শিকার, পরিবেশদূষণ ও আবাস ধ্বংসের কারণে গত ২৫ বছরে প্রায় ৩০ শতাংশ রাজকাঁকড়া দেশ থেকে হারিয়ে গেছে।

রাজকাঁকড়া বহিঃকঙ্কালে আবৃত। দেহ তিন ভাগে বিভক্ত। ঘোড়ার খুর আকারের সামনের অংশটি মাথা (প্রোসোমা), যার নিচে মস্তিষ্ক, মুখ, হৃৎপিণ্ড, ছয় জোড়া পা, স্নায়ুতন্ত্র ও গ্রন্থিতন্ত্র সুরক্ষিত থাকে। দুটি যৌগিক চোখসহ মাথায় মোট নয়টি চোখ ও কিছু লাইট রিসিপটর থাকে। মাথার পেছনের কাঁটাযুক্ত ত্রিকোণাকার অংশটি উদর (অফিস্তোসোমা), যা প্রাণীটির চলাফেরা, আত্মরক্ষা ও শ্বাসপ্রশ্বাসে সাহায্য করে। লম্বা, চোখা ও গোলাকার লেজটি (টেলসন) দেখতে ভয়ংকর হলেও বিষাক্ত নয়। প্রাণীটি উল্টে গেলে লেজের মাধ্যমে পিঠে চাপ দিয়ে দেহকে সোজা করে। রাজকাঁকড়ার শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম যুগ যুগ ধরে পরিবর্তিত হলেও এর বহিঃকঙ্কালের তিনটি অংশ প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। ডায়নোসরের চেয়েও প্রাচীন প্রাণীটির পুরোনো জীবাশ্মের সঙ্গে বর্তমানকালের চেহারা পুরোপুরি মিলে যায়।

স্ত্রী ও পুরুষ রাজকাঁকড়ার মাথা যথাক্রমে ১৬ ও ১৪ সেন্টিমিটার চওড়া। স্ত্রী আকারে বড়। গোলাকার লেজটিও প্রায় ১২-১৪ সেন্টিমিটার। দেহের ওপরের রং জলপাই-বাদামি ও নিচটা খয়েরি।

এরা কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সোনাদিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও সুন্দরবনে বাস করে। নিশাচর প্রাণীটি জীবনের বেশির ভাগ সময় উপকূলীয় অগভীর জল বা নোনাজলের পলিময় নরম ও বেলে মাটিতে কাটায়। সচরাচর জলজ কীটপতঙ্গের শূককীট, ছোট মাছ, খুদে কাঁকড়া, শেওলা ইত্যাদি খায়। চোয়াল বা দাঁত না থাকায় পেছনের পায়ের মাধ্যমে খাবার ভেঙে সামনের পা দিয়ে মুখে পোরে।

বসন্তের শেষ থেকে গ্রীষ্মের শুরু প্রজননকাল। পূর্ণিমার রাতে ভরা জোয়ারের সময় এরা সমুদ্রের তলা থেকে সৈকতে আসে। স্ত্রী সৈকতের নরম বালি খুঁড়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে এবং পুরুষ সেগুলো শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করে। এভাবে কয়েকবারে স্ত্রী প্রায়
১০ হাজার ডিম পাড়ে। প্রায় দুই সপ্তাহে ডিম ফুটে শূককীট বের হয়। লেজহীন শূককীট হুবহু বয়স্ক রাজকাঁকড়ার মতো, শুধু আকারেই ছোট। শূককীট সৈকত থেকে সমুদ্রের বালুময় তলায় গিয়ে অবস্থান নেয় ও বছরখানেক এভাবে কাটায়। এরপর খোলস পাল্টিয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে আকারে বাড়ে ও সমুদ্রের গভীরে চলে যায়। ১০ বছরে ১৬-১৭ বার খোলস পাল্টে শূককীট প্রাপ্তবয়স্ক হয়। আয়ুষ্কাল প্রায় ২০ বছর।