বিলুপ্ত ৩১ প্রজাতির প্রাণী

চিতা (বিলুপ্ত) l ছবি: অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ
চিতা (বিলুপ্ত) l ছবি: অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ

লোভ আর হিংস্রতা বোঝাতে যে প্রাণীটির উদাহরণ দেওয়া হয়, সেটা হায়েনা। রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকার ঊষর লাল মাটিতে উনিশ শতকের শেষের দিকেও ঘুরে বেড়াত ধূসর হায়েনার দল। তবে এখন বরেন্দ্র তো বটেই, বাংলাদেশের কোথাও হায়েনা নেই। একসময় এ দেশে গন্ডারও ছিল। গত ১০০ বছরে বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে এমন ৩১ প্রজাতির প্রাণী।
বাংলাদেশের ১ হাজার ৬১৯ প্রজাতির বন্য প্রাণীর কোনটির কী অবস্থা, সে-বিষয়ক লাল তালিকা বা রেড লিস্টের হালনাগাদ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এটি যৌথভাবে তৈরি করেছে সরকারের বন বিভাগ এবং প্রকৃতি সংরক্ষণ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)। ১৫ বছর পর করা এই প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
নতুন তালিকায় দেখা যায়, দেশের ৩৯০টি বন্য প্রাণী কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন। তবে তালিকায় ১৪টি নতুন প্রজাতিও যুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচটি ইঁদুরের ও পাঁচটি প্রজাপতি বর্গের প্রজাতি।
২০০০ সালের প্রথম তালিকায় ২৬৬ প্রজাতির মাছ, ২২ প্রজাতির উভচর, ১০৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির পাখি, ১১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল। তাতে তারা এর আগের ১০০ বছরের মধ্যে ১৩ প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রমাণ পায়।
আইইউসিএন বিশ্বব্যাপী একই পদ্ধতি ব্যবহার করে এবারই প্রথম প্রাণিকুলের অবস্থা-বিষয়ক প্রতিবেদন বা রেড লিস্ট তৈরি করছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশে এই তালিকা দুই বছর ধরে ২০০ জন বিজ্ঞানী মিলে চূড়ান্ত করেছেন। আজ বুধবার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাণিকুলের অবস্থার এই হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করা হবে।

ডলফিন (মহাবিপন্ন) l ছবি: জাহাঙ্গীর আলম
ডলফিন (মহাবিপন্ন) l ছবি: জাহাঙ্গীর আলম

২০০০ সালে রেড লিস্ট তৈরির সময় আইইউসিএন, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ছিলেন অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তাঁর কাছে এই তালিকার গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশের ক্ষতির কারণে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। নানা উন্নয়নমূলক কাজ এবং প্রকৃতির পরিবর্তনের প্রভাবও বন্য প্রাণীর ওপর পড়ছে। রেড লিস্ট তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই পরিবর্তনের ফলে বন্য প্রাণীর বর্তমান অবস্থা কী দাঁড়াল, সে সম্পর্কে ধারণা নেওয়া।

২০১৪ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত করা এবারের তালিকার প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রেজা খান। এবারের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে আইইউসিএনের আন্তর্জাতিক সর্বজনীন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। সাতটি পর্যায়ে প্রতিটি প্রাণী-বিষয়ক তথ্যকে যাচাই-বাছাই করে তা প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়েছে।

তালিকায় দেখা যায়, গত ১৫ বছরে পাখি প্রজাতি সবচেয়ে বেশি বিলুপ্ত হয়েছে। দেশের ৫৬৬ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৯টি গত ১০০ বছরের বেশি সময়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তির দৌড়ে দ্বিতীয় অবস্থান স্তন্যপায়ী প্রাণীদের। ১১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী হারিয়ে গেছে এই সময়ে। আর সরীসৃপজাতীয় প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে একটি।

রেড লিস্টের পাখি-বিষয়ক দলের প্রধান ইনাম আল হক এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বব্যাপী বন্য প্রাণী বিপদে আছে। এর মধ্যে এশিয়ায় প্রকৃতিকে ধ্বংস করার তৎপরতা বেশি হওয়ায় এখানে বন্য প্রাণীও দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের বন্য প্রাণীর অবস্থা কিছুটা ভালো।

প্রতিবেদনটিতে বিপন্ন প্রাণীর তালিকাকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মহাবিপন্ন প্রাণী ৫৬টি, বিপন্ন ১৮১টি এবং ঝুঁকিতে আছে ১৫৩টি প্রজাতি। আর ঝুঁকির কাছাকাছি রয়েছে ৯০ প্রজাতির প্রাণী। তবে ৮০৩ প্রজাতির প্রাণী নিয়ে এখন পর্যন্ত দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

সবুজ ময়ূর (বিলুপ্ত) l ছবি: আইইউসিএন
সবুজ ময়ূর (বিলুপ্ত) l ছবি: আইইউসিএন

বিলুপ্ত প্রাণী: স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ডোরাকাটা হায়েনা রাজশাহী অঞ্চলে, ধূসর নেকড়ে নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে, নীলগাই দিনাজপুর-পঞ্চগড় এলাকায়, বান্টিং বা বনগরু চট্টগ্রাম ও সিলেটে এবং বনমহিষ দেশের সব বনাঞ্চলেই দেখা যেত। এ ছাড়া তিন ধরনের গন্ডার ছিল বাংলাদেশে: সুমাত্রা গন্ডার, জাভা গন্ডার ও ভারতীয় গন্ডার। বাদা বা জলার হরিণকে স্থানীয়ভাবে বলা হতো বারো শিঙা হরিণ। এটি সিলেট ও হাওর এলাকায় দেখা যেত। কৃষ্ণষাঁড় নামে একটি প্রাণী ছিল রাজশাহী ও দিনাজপুর এলাকায়। আর মন্থর হরিণ পাওয়া যেত পার্বত্য চট্টগ্রামে। এই ১৩ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে বেশির ভাগই গত শতাব্দীতেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র মন্থর ভালুক নামে ভালুকের একটি প্রজাতি গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে।

মহাবিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় রয়েছে বেঙ্গল টাইগার, হাতি, ভোঁদড়, লামচিতা, চিতা, বনরুই, উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, বনগরু, সাম্বার হরিণ, প্যারাইল্লা বানর, হিমালয়ান ডোরা কাঠবিড়ালি ও কালো ভালুক।

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এ দলের প্রধান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, মূলত বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে বাসস্থান হারিয়ে এই প্রাণীগুলো বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

পাখি: পাখির মধ্যে লালমুখ দাগিডানা একসময় সিলেটে দেখা যেত। সেখানকার পাহাড়ি বাঁশঝাড়ে এরা বাসা বাঁধত। ওই বিশেষ জাতের পাহাড়ি বাঁশঝাড় প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় এই পাখিরাও এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার একেকটি সারস বাংলার নদীর ধারে ঘুরে বেড়াত। জলাভূমির শামুক ও ঝিনুক ছিল এদের খাবার। মূলত শিকারিদের কবলে পড়ে এই বিশাল পাখিটি এ দেশ থেকে হারিয়ে গেছে।

এ ছাড়া ধূসর মেটে তিতির ও বাদা তিতির পাখিও হারিয়ে গেছে। বাংলার বিখ্যাত বাদি হাঁস, গোলাপি হাঁস, বড় হাড়গিলা বা মদনটাক, ধলাপেট বগ, সাদাফোঁটা গগন রেড, রাজ শকুন, দাগি বুক টিয়াঠুঁটি, লালমাথা টিয়াঠুঁটি, গাছ আঁচড়া, সবুজ ময়ূর চিরতরে এ দেশ থেকে হারিয়ে গেছে।

উভচর প্রাণীদের নিয়ে তালিকা প্রস্তুতের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানের নেতৃত্বে একদল গবেষক। বান্দরবানের রুমায় চামড়া ঝোলা ব্যাঙ এবং কেঁচোর মতো দেখতে নীল রঙের একটি নতুন উভচর প্রাণীও মহাবিপন্ন উভচর প্রাণীর তালিকায় উঠে এসেছে। বিপন্নের তালিকায় এসেছে চিত্রিত ব্যাঙ, বেলুন ব্যাঙ, চ্যাপ্টা মাথা ব্যাঙ, ঝরনা সুন্দরী ব্যাঙ, বড় গেছো ব্যাঙ।

এ ব্যাপারে মনিরুল এইচ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ায় উভচর প্রাণীরা বিপদে আছে। আমরা আমাদের প্রতিবেদনে বিপদের চিত্র তুলে ধরেছি। সরকারের কাজ তা সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া।’

৩০৫ প্রজাতির প্রজাপতি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একদল গবেষক কাজ করেছেন। তাঁরা সুন্দরবন ক্রো বা বাংলার কাক নামে প্রজাপতির একটি জাতকে মহা বিপদাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এটি মূলত সুন্দরবনের কটকা ও কচিখালী এলাকার আট কিলোমিটার বিস্তীর্ণ বনে বসবাস করে।

এ ব্যাপারে মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, লবণাক্ততা ও পর্যটকদের উৎপাতের কারণে আকন্দগাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই এই গাছের ওপর নির্ভরশীল প্রজাপতিও মহা বিপন্নের তালিকায় ঢুকে পড়েছে।

সরীসৃপজাতীয় প্রাণীর মধ্যে মিঠাপানির কুমির বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে। বন্য পরিবেশ থেকে এটি অনেক আগেই হারিয়ে গেলেও বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মাজারে দুটি মিঠাপানির কুমির ছিল। দুই বছর আগে এরা মারা গিয়ে এই প্রজাতিই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া পদ্মার চর ও দেশের বেশির ভাগ এলাকায় একসময় ঘড়িয়াল পাওয়া যেত। এই প্রাণী দুটি এবার মহাবিপন্নের তালিকায় প্রবেশ করেছে।