
এ বছরের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখের ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে গিয়েছিল পানের বরজটি। পানগুলো গিয়েছিল শুকিয়ে। ওই শুকনো পানের ডগার ভেতরের মাটিতে বসে বসে পাখিটি যে ডিমে তা দিচ্ছে, তা আমি জানতাম না। কাছে যেতেই প্রথমে কানে এল গোখরো সাপের চাপা স্বরের ফোঁসফোঁসানি, থমকে দাঁড়ালাম। পরমুহূর্তেই দেখতে পেলাম সুন্দর পাখিটিকে। বাসার ওপরে দাঁড়িয়ে গেছে প্রায় সোজা হয়ে, শরীরের পালক ফুলিয়ে আর মাথা দুলিয়ে ফোঁসফোঁস করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে আমাকে।
১৯৯৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই পাখির বাসা দেখেছিলাম। ডিম ফুটে ছানা হওয়ার পরেও দেখেছিলাম। তারপর আরও দু-চারবার বাসা-ডিম দেখলেও ছানা দেখিনি। নিজের গ্রামেই (ফকিরহাট, বাগেরহাট) বাসা ও পেটের তলায় তিনটি ছানা দেখলাম। কালচে-বাদামি রঙে চিত্রিত ডিমের ওপরে হলুদাভ আভা। ছানা তিনটির বয়স তিন দিনের বেশি হবে না।
পাখিটির নাম বৈরাগী চ্যাগা। চালচলন ও হাবভাবে একটা বৈরাগ্য ভাব আছে এদের। মাথা-ঘাড়-পিঠজোড়া যেন গেরুয়া বসন। কপাল থেকে মাথার তালু হয়ে ঘাড় পর্যন্ত সাদা টান। বৈরাগীদের কপালে এ রকম সাদা তিলক থাকে। ঘাড়-পিঠ-লেজ ও বুকের দুপাশে ঝলমলে চিত্রিত রং। এদের আরেক নাম তাই রঙিলা চ্যাগা। এটি আমাদের দেশি পাখি। পুরুষের পাখার ওপরের কারুকাজটা শিল্পিত। মেয়েটির পাখার ওপরের সূক্ষ্ম কারুকাজ আরও বেশি সুন্দর। মেয়েটির দুই পাখার উপরিভাগ ধাতব জলপাই-বাদামি, তাতে সবুজাভ আভা থাকে, পেটের দুপাশ ও লেজের ওপরে আড়াআড়ি কালো ও হলুদাভ রঙের চওড়া ব্যান্ড আছে। ঘাড়-বুক-চোখের পাশটা গাঢ় জলপাই-বাদামি, চোখের পেছনে সাদা টান, গলা-বুকের নিচটা ও পেট সাদা। পুরুষটির পেটও সাদা। দুজনেরই মাথার চাঁদির ওপর দিয়ে দুটি সোনালি রেখা বয়ে গেছে। হলুদাভ ঠোঁট এদের, সবুজাভ পা।
মূল খাদ্য কীটপতঙ্গ-ধানসহ নানান রকমের শস্যবীজ ও কচি ঘাসের ডগা-পাতা, জল-কাদার ভেতরের সুতোপোকা ও কেঁচোও খায়।
বাসা বাঁধতে পারে বছরের যেকোনো সময়ে। মাটির ওপরে সরু-শক্ত শুকনো ঘাস বিছিয়ে অগোছালো বাসা করে পুরুষটি। এদের মেয়েরা বহুগামী। এক পুরুষে মন ভরে না। তাই পটিয়ে-পাটিয়ে অন্য পুরুষকে বশ করে ফেলে, এই বশ করতে গিয়ে প্রায় সময়েই লড়তে হয় অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে, যে-ও কি না একই পুরুষকে বশ করতে চাইছে। তারপরে বাসায় ৩-৪টি ডিম পেড়েই অন্য পুরুষের খোঁজে ভেগে যায়। পুরুষটি একাই ১৭-১৯ দিন ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোটায় ও লালন-পালন করে।
সুদর্শন, দুর্লভ এই বৈরাগী চ্যাগাদের ইংরেজি নাম Greater Painted Snipe. বৈজ্ঞানিক নাম rostratula benghalensis. মাপ ২৬ সেমি। ওজন ১২৫ গ্রাম। সারা দেশের জলাভূমির আশপাশে দেখা মিলতে পারে। তবে দেখতে পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়।