ভুতুম প্যাঁচার পাঁচালি

মা-হারানো সেই ভুতুমের ছানা l ছবি: মুস্তাহিদ সুজা
মা-হারানো সেই ভুতুমের ছানা l ছবি: মুস্তাহিদ সুজা

ছানাটির কোনো দোষ ছিল না। দোষ ছিল না ওর মায়েরও। কিন্তু মাছের ঘেরমালিকের দৃষ্টিতে মা পাখিটি ছিল ঘোর অপরাধী। রোজ রাতে সে ঘের থেকে দু-চারটি করে মাছ ছোঁ দিয়ে তুলে নেয়; নিজে খায়, বাচ্চাদের খাওয়ায়। এসব প্রতিটি রুই-কাতলা-মৃগেলের পোনা একদিন বড় হতো। ঘেরমালিকের অনেক টাকা লাভ হতো। মালিক কি এই ক্ষতি মেনে নিতে পারেন? অতএব এক বন্দুকধারীকে ভাড়া করে এনে এক রাতে মা পাখিটিকে গুলি করে নিকেশ করে ফেললেন। ওই ভাড়াটে পাখি শিকারি এই মৌসুমেই ঘের থেকে মাছ ধরার অপরাধে গুলি করে তিনটি ইগলকেও খতম কেরছেন।
এই মা পাখিটি মারা যাওয়ার পরে বাসার উড়ু উড়ু তিনটি ছানা খিদেয় কাতর। পর পর দুই রাত কাটানোর পর ভোররাতের দিকে বড় ছানাটি বাসা থেকে লাফিয়ে পড়ল নিচে। ব্যস! পড়ে গেল দুষ্টু ছেলেপুলেদের কবলে। ওদের কবল থেকে বাচ্চাটিকে উদ্ধার করে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বাড়িতে নিয়ে গেলেন। রাখলেন ঘরের পাটাতনে। দিন পনেরো তিনি ছোট মাছ-ব্যাঙ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখলেন ছানা তিনটিকে (বাকি দুটি ছানা লোক দিয়ে তিনি বাসা থেকে নামিয়ে এনেছিলেন)। পরে এক রাতে উড়িয়ে দিলেন। এই ঘটনা আমাদের গ্রাম বাগেরহাটের ফকিরহাটের শাতশৈয়ার।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এতে লাভ কিছুই হবে না। হবে না কারণ, খাবারের জন্য ওদেরকে আবার রাতে কোনো না কোনো পুকুর-দিঘি বা মৎস্যঘেরে আসতে হবে। মারাও পড়তে হবে অব্যর্থ লক্ষ্য কোনো শিকারির গুলিতে।
পাখিটির নাম ভুতুম প্যাঁচা। ইংরেজি নাম Brown fish owl৷ বৈজ্ঞানিক নাম Ketupa Zeylonensis৷ মাপ ৫৬ সেন্টিমিটার। মূল খাদ্য এদের মাছ, ছোট ও মাঝারি ইঁদুর-ব্যাঙও খায়। নিশাচর এই পাখিটি যেকোনো এক পা দিয়ে মাছ ধরে গাঁথে, তারপর উড়াল দিয়ে বসে গিয়ে গাছের ডালে।
শৈশব-কৈশোরে, বিশেষত হেমন্ত-শীতে রাতে শুয়ে ভুতুমের গুরুগম্ভীর ‘ভূত ভূত...ভূত ভুতুম’ বা ‘বুদ বুদ বুদ বুদুম’ ডাক শুনে ভয় পেতাম। আমাদের রান্নাঘরের পেছনের নারকেলগাছের পাতার ওপরে বসত একটি, জোড়ের আরেকটি বসত কিছুটা দূরের কোনো গাছে৷ দুটিতে একটানা অনেকক্ষণ ডাক চালাচালি করত। গ্রামাঞ্চলে কুসংস্কার আছে, বাড়ির আশপাশে ভুতুম ডাকলে অমঙ্গল হয়। আসলে ভুতুমের ডাকের সঙ্গে বাড়ির অমঙ্গলের কোনো সম্পর্ক নেই। আজও ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গেলে রাতে ঘরে শুয়ে ভুতুমের ডাক চালাচালি শোনার সৌভাগ্য আমার হয়। এখন আর ভয় পাই না। মনে হয়, শুনছি কোনো উচ্চাঙ্গসংগীতের বোলচাল।
ভুতুম ও মেছো ইগলেরা আজ আর মোটেও ভালো নেই আমাদের দেশে। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল তথা বৃহত্তর ফরিদপুর-ময়মনসিংহসহ প্রায় সারা দেশের জলাশয় বা হাওর-বিল আজ কি এমন অবস্থায় আছে আমাদের দেশে, যেখান থেকে অবাধে খাবার জোগাড় করতে পারে এই দুই প্রজাতির পাখি? সর্বত্র বাণিজ্যিকভাবে মাছের চাষ হচ্ছে। পাখিগুলোকে ঘেরে বা মৎস্য খামারে যেতেই হয় পেটের তাগিদে এবং অনিবার্য কারণে মারা পড়তে হয়। মাছের ক্ষতি ঘেরমালিকেরা মেনে নিতে নারাজ। কিন্তু ওদেরও ঘেরে যাওয়া ছাড়া নেই কোনো গতি। তাহলে সমাধান কী এই সমস্যার?
আমি িক বাড়ি গিয়ে বা দেশের যেকোনো এলাকায় গিয়ে রাতের বেলায় ‘বুঝলি বুঝলি?’ ‘বুঝলুম বুঝলুম’, ‘কী বুঝলি, কী বুঝলি?’ ‘সব বুঝলুম, সব বুঝলুম’—এমন ডাক শুনতে পারব না ভুতুমের? দিনের বেলায় মেছো ইগলের আশ্চর্যসুন্দর ও শৈল্পিক ডাইভ দেখতে পারব না জলাশয়ের জলে? শুনতে পারব না ওদের পাড়াকাঁপানো ডাক?
দেশে ভুতুমদের অবস্থা ভালো নয়। ভুতুম ও মাছখেকো ইগলদের টিকিয়ে রাখার জন্য এখনই কিছু একটা করা জরুরি। কিন্তু করবেটা কে বা কারা?