মধুপুর বন এখন বাণিজ্যিক বাগান

দেশের প্রধান তিন বনাঞ্চল সুন্দরবন, পার্বত্য এলাকার বন ও মধুপুর নিয়ে প্রতিবেদনের শেষ পর্ব আজ।

  • মধুপুরে ১৯ হাজার ৮৬১ একর বনভূমি দখল হয়েছিল।

  • ১৫ থেকে ২০ বছরে ৪ হাজার ৪৮২ একর বনভূমি উদ্ধার।

বনের জমিতে বাণিজ্যিকভাবে আনারস ও কলা চাষ করা হচ্ছে। সম্প্রতি মধুপুর শালবনের কাইলাকুড়ী সংলগ্ন এলাকায়
ছবি: শিশির মোড়ল

মধুপুর বন বাণিজ্যিক বাগানের চেহারা পেয়েছে। বনের জায়গা দখল করে চাষ হচ্ছে কলা, আনারস, আদা ও পেঁপে। চার দশক ধরে চলছে রবার চাষ। বন বিভাগ শালগাছ কেটে লাগিয়েছিল বিদেশি প্রজাতির ইউক্যালিপটাস ও আকাশিয়া গাছ। বনের মধ্যে গড়ে ওঠা মানুষের বসতি দিন দিন বড় হচ্ছে। কম দেখা যাচ্ছে বন্য প্রাণী। চাপ নিতে পারছে না দেশের বৃহত্তম এই শালবন।

সাধারণত ময়মনসিংহ–টাঙ্গাইল যাওয়া–আসার পথে চোখে পড়ে ওই শালবন। এই পথে মধুপুর উপজেলা সদরের ১০ কিলোমিটার উত্তরে জায়গাটির নাম পঁচিশমাইল। বনের জায়গা

হলেও সেখানে বন নেই। সেখানে আনারস ও কলার পাইকারি বাজার। পঁচিশমাইল থেকে আঁকাবাঁকা পথ ধরে যেতে হয় কাইলাকুড়ী। দূরত্ব ২০ কিলোমিটারের মতো। সেখানে গরিবের চিকিৎসক বলে খ্যাত এড্রিক বেকারের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে।

১৩–১৪ মার্চ কাইলাকুড়ী যেতে পথে চোখে পড়ে আনারস ও কলার বাগান। আনারসের বাগান শেষ হলেই শুরু কলার বাগান। কোথাও আনারস চাষের জন্য জমি তৈরি করা হচ্ছে। চার–পাঁচ দশক আগে এসব জমি ছিল বন বিভাগের। এখন এসব জমি মান্দি (গারো), কোচ ও বাঙালিদের দখলে।

পুরোটাই গ্রামীণ পথ। কোথাও বন নেই, বনের পরিবেশ নেই। রাস্তার দুপাশে পাকা বাড়ি, আধাপাকা বাড়ি, মাটির দেয়ালের ঘর। কিছু পথ পর পর কয়েকটি দোকান নিয়ে একেকটি বাজার। চারতলা স্কুল, আছে গির্জা ও মসজিদ। এসব স্থাপনা বনের জমিতে।

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর বনাঞ্চলে পাঁচটি ইউনিয়ন। ওই পাঁচ ইউনিয়নে ৫৮টি স্কুল, ৩৮টি মাদ্রাসা ও ছোট–বড় ৪০টি বাজার আছে। জনসংখ্যা এক লাখের ওপরে। ইউনিয়নগুলোর অধিকাংশ জমি বন বিভাগের। বেরিবাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুলহাস উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ইউনিয়নের আয়তন ৩৯ বর্গকিলোমিটার। ইউনিয়নের ৮০ শতাংশ জমি বন বিভাগের। জনসংখ্যা ১৮ হাজার।

কাইলাকুড়ী যাওয়ার পথে চোখে পড়ে বন বিভাগের দোখলা রেঞ্জ অফিস। ১৯৭২ সালে এই রেঞ্জ অফিসের পাশে দোখলা রেস্ট হাউসে বসে লেখা হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধান। এটি মধুপুর জাতীয় উদ্যানের মধ্যে। উদ্যানের মধ্য নিয়ে ইটের একটি রাস্তা ময়মনসিংহ–টাঙ্গাইল সড়কে গিয়ে পড়েছে। ইটের রাস্তার শেষে বন বিভাগের রসুলপুর বিট অফিস।

ইটের রাস্তার দুপাশে চোখে পড়ে শাল, বাঁশ, বেতসহ নানা ধরনের গাছ। মধুপুর বনের যে দুটি অঞ্চলে এখনো প্রাকৃতিক পরিবেশ অবশিষ্ট আছে, এটি তার মধে৵ একটি।

মধুপুর বন মূলত ঝরাপাতার বন। শীতের শেষে বসন্তে পাতা ঝরে যায়। একসময় ঝরা পাতা বৃষ্টির পানিতে পচে। পচা পাতা বনকে পুষ্টি দেয়, সমৃদ্ধ করে—এটিই শালবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

বনের মধ্যে পাতা কুড়ানোর হিড়িক চোখে পড়ল। বনে ঢুকেছে অনেক ভ্যান ও ইজিবাইক নিয়ে কিছুসংখ্যক মানুষ। পাতার বস্তা বা বোঝা নিয়ে তারা বন ছাড়ছে। ওই পাতা তারা বিক্রি করে কলা বা আনারস বাগানের মালিকের কাছে। যে পাতা বনের দরকার, সেই পাতা বন পায় না।

কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা যায়, পথের পাশে দেয়ালঘেরা ‘লহরিয়া বিট কাম হরিণ প্রজননকেন্দ্র’। সেখানে কিছু বানর চোখে পড়ে। এগুলো বনে খাবার খুঁজে পায় না। মানুষের ছিটানো খাবার খেয়ে বেঁচে আছে। এক কর্মচারী জানান, প্রজনন

কেন্দ্রে প্রায় ১০০ হরিণ আছে। এসব হরিণ সুন্দরবন থেকে আনা।

আরও পরে রসুলপুর। ওখান থেকে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়ক ধরে পঁচিশমাইল পাইকারি বাজারে পৌঁছানো যায়। পথের দুপাশে প্রাকৃতিক বনের শেষ অংশটুকু চোখে পড়ে। রসুলপুরে বন বিভাগের দুটি কার্যালয়। একটি টাঙ্গাইল বন বিভাগের। আরেকটি ময়মনসিংহ বন বিভাগের কার্যালয়, সড়কের অন্য পাশে।

বন বিভাগের টাঙ্গাইল অংশে কয়েকটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। তার একটিতে বলা আছে—‘মধুপুর জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশেরবৃহত্তম শালবন। এই বন ৪ প্রজাতির উভচর

প্রাণী, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ২০৪ প্রজাতির পাখি এবং ১১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল।’ ছবিসহ বিশেষভাবে বলা আছে মুখপোড়া হনুমানের কথা। লম্বা লেজ ও শরীরের নিচের অংশ কমলা রঙের এই হনুমান এখন বৈশ্বিক ঝুঁকিপূর্ণ প্রাণীর তালিকায়।

বনের ক্ষতি

বন বিভাগ গত শতকের আশির দশকে মধুপুর বনে প্রায় পাঁচ হাজার একর জমিতে বিদেশি প্রজাতির গাছ লাগিয়েছিল। এখন বলছে, ওই বিদেশি গাছ লাগানো ভুল ছিল। দোখলা রেঞ্জ অফিসের সামনে একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা: ‘ইউক্যালিপটাস গাছ প্রতিদিন প্রায় ৯০ লিটার পানি শোষণ করে। এই গাছের পাতা পানিতে পচে না, পানিকে দূষণ করে। আকাশমনি (আকাশিয়া) মাটি থেকে বেশি পরিমাণ খাবার ও পানি শোষণ করে। তাই এই গাছকে বলা হয় রাক্ষসী গাছ।

সরকার এসব গাছ লাগানো নিষিদ্ধ করার পর সেই জমিতে এখন কলা ও আনারসের চাষ হচ্ছে।

আশির দশকের শেষ দিকে মধুপুর বনের ৭ হাজার ৮০০ একর জমিতে রবারের ৫টি বাগান করা হয়। এর মধ্যে সন্তোষপুর রবার বাগানের কর্মকর্তারা বলছেন, বাগানটি লোকসানে চলছে।

বনের ক্ষতির জন্য বন বিভাগ সাধারণ মানুষের ওপর দোষ চাপায়। বনের জমি দখল ও বনের সম্পদ লুটের অভিযোগে নিয়মিত মামলা করে বন বিভাগ। বহু মানুষ ‘বন মামলা’ মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১০০টি মামলা দেওয়ার নজিরও মধুপুর বনে আছে।

টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দখল হয়ে যাওয়া বনভূমি উদ্ধারের কাজ চলমান আছে। মধুপুর গড়ের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সম্পৃক্ত করে দখল হওয়া বনভূমি উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

আয়তনের দিক থেকে সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনের পর দেশের তৃতীয় বৃহত্তম মধুপুর শালবন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে মধুপুর এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করছেন এবং বন ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করছেন সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) নির্বাহী পরিচালক ফিলিপ গাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৪৫ হাজার একর জমি নিয়ে মধুপুর বনাঞ্চল। এখন প্রাকৃতিক বন আছে নয় হাজার একর বা তার কিছু বেশি জমিতে।