মহাবিপন্ন উল্লুকের দেখা
শ্রীমঙ্গলের বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী ও উদ্ধারকারী খুকন থৌনাজাম ও ভাগনে জাহিনুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে মৌলভীবাজারের বন ও চা-বাগানে ঘুরছি। কুরমা, লাউয়াছড়া ও কুলাউড়া হয়ে শেষ দিন অর্থাৎ ৬ নভেম্বর রাজকান্দি সংরক্ষিত বনের আদমপুরে গেলাম। পাঁচ বছর আগে শেষবার এখানে এসেছিলাম। সিএনজিচালক খুকন ও আমাকে কাউয়ারগলা স্থানে নামিয়ে দিয়ে গেল। সেখান থেকে হাঁটাপথ ধরলাম। ছড়া ও পাহাড়ি পথ—দুটিই পাশাপাশি চলে গেছে। তবে লাউয়াছড়ার মতো এই বনও উঁচু গাছে ভরা। বেশির ভাগ পাখিই গাছের মগডালে বসে থাকে। তাই ছবি তুলতে কষ্ট হয়। এ কারণে ছড়া দিয়ে না গিয়ে পাহাড়ি পথে হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু ভাগ্য তেমন একটা প্রসন্ন ছিল না। তেমন কোনো পাখি চোখে পড়ল না। পাহাড়-টিলার বন্ধুর পথে ঘণ্টা দেড়েক পাখি খুঁজে বনের কিছুটা গহিনে চলে এলাম। হঠাৎই উঁচু একটি গাছের দিকে চোখ গেল। গাছের মগডালে কালো কিছু একটাকে নড়াচড়া করতে দেখে দ্রুত ক্যামেরা তাক করলাম। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল! ৯ বছর আগে এই বনেই ওদের একটি পরিবারের দেখা পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে যতবার এসেছি, ওদের দেখা পাইনি। নিরীহ প্রাণীগুলো বর্তমানে এ দেশে মহাবিপন্ন হিসেবে বিবেচিত। পুরো চারজনের পরিবারের দেখা পেলাম এবার। ধৈর্যের সঙ্গে একেক করে প্রতিটির ছবি তুললাম।
এতক্ষণ মহাবিপন্ন যে প্রাণীগুলোর কথা বললাম, ওরা এ দেশের অতিবিরল স্তন্যপায়ী প্রাণী উল্লুক। বনমানুষ, নরবানর, হুতু বান্দর বা কালা বান্দর নামেও পরিচিত। এরাই এ দেশের একমাত্র লেজবিহীন বানর। ইংরেজি নাম ওয়েস্টার্ন হুল্লুক গিবন বা হোয়াইট-ব্রাউড গিবন। গোত্র হাইলোব্যাটিডি ও বৈজ্ঞানিক নাম Hoolock hoolock। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও মিয়ানমারে দেখা যায়।
উল্লুক উচ্চতায় ৪০-৬৩ সেন্টিমিটার। তবে সোজা হয়ে দাঁড়ালে এক মিটার পর্যন্ত হতে পারে। হাত অস্বাভাবিক লম্বা—পায়ের প্রায় দ্বিগুণ; দাঁড়ানো অবস্থায় মাটি ছুঁই ছুঁই করে। ওজন ছয় থেকে আট কেজি। বয়স ও লিঙ্গভেদে দেহের রঙের তারতম্য হয়। ভ্রু ছাড়া পুরুষগুলোর পুরো দেহ কালো লোমে আবৃত থাকে। স্ত্রীগুলো হলদে-ধূসর রঙের। ভ্রু সাদা ও চোখের চারদিকে থাকে সাদা বলয়। হাত এবং হাত ও পায়ের আঙুল কালো। বাচ্চাগুলোর লোম ধূসর-সাদা; বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যা কালো হয়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীগুলো হলদে-ধূসর বর্ণ ধারণ করে।
ওরা মিশ্র চিরসবুজ ও পাতাঝরা বনের বাসিন্দা। বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ি বনে উল্লুকের দেখা মেলে।
মে থেকে আগস্ট প্রজননকাল। স্ত্রী তিন বছর পর পর বাচ্চা দেয়। প্রায় ছয় মাস গর্ভধারণের পর একটিমাত্র বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চারা প্রায় ছয় মাস মায়ের দুধ পান করে এবং দুই বছর বয়সে দুধ ছাড়ে। সচরাচর পাঁচ থেকে ছয় বছরে পূর্ণবয়স্ক হয়। এরপর মা–বাবাকে ছেড়ে জুটি খুঁজে নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবনধারণ করে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১৭ বছর। বন ধ্বংস, শিকার ও মানুষের অত্যাচারে গত ৪০ বছরে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত উল্লুক কমে গেছে। বর্তমানে এ দেশে উল্লুকের সংখ্যা ২৫০টির কম।