মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা খাসিয়াপুঞ্জির মেঘা নামের এক ব্যক্তির হাতে একটি মহাবিপন্ন প্রাণী ধরা পড়ে, গত ১২ মে। প্রাণীটি নিয়ে কী করা যায়, সে বিষয়ে মেঘা এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করেন। ওই ব্যক্তি তাঁকে এটি বিক্রির পরামর্শ দেয়, কারণ প্রচুর টাকা পাওয়া যেতে পারে। এ কথায় মেঘা লোভে পড়ে যায় ও শ্রীমঙ্গলের বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সজল জানায়, বন্য প্রাণী ধরা ও বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এতে মেঘা ভয় পেয়ে মুঠোফোন বন্ধ করে রাখেন।
মেঘার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে না পেরে সজল শ্রীমঙ্গলের কিছু প্রাণীপ্রেমী উদ্যমী তরুণদের সংগঠন এসইডব্লিউর (স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনড্যাঞ্জারড ওয়াইল্ডলাইফ) সোহেল সিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ও প্রাণীটি উদ্ধারের জন্য বলেন। সোহেল ওই সংগঠনের খুকন থৌনাউজাম ও কাজল হাজরাকে জানান। এরপর তাঁরা মৌলভীবাজারের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ও দ্রুত উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন। কারণ, প্রাণীটি যদি পাচারকারীদের হাতে পড়ে যায়, তবে উদ্ধার করা কঠিন হবে।
প্রথমেই তাঁরা পাত্রখোলা ও কুরমা খাসিয়াপুঞ্জিতে টিমের সদস্যদের কাছে মেঘার মুঠোফোনের নম্বর ছড়িয়ে দেন। কিন্তু সেখানে মেঘা নামে কাউকেই পাওয়া গেল না এবং জানা গেল যে ওই ব্যক্তির নাম মেঘা নয়, জুয়েল। তাঁর বাড়ি কুলাউড়ার জাপান পানপুঞ্জিতে। এরপর তাঁরা পাত্রখোলা পুঞ্জির সেকেন্ড হেডম্যানের সাহায্যে জুয়েলের মুঠোফোন খোলানোর ব্যবস্থা করেন এবং সেখানে পৌঁছান। কিন্তু জুয়েল বলেন, প্রাণীটি খাঁচার ফাঁক দিয়ে পালিয়ে গেছে। এরই মধ্যে বন বিভাগের টিমও পৌঁছে যায় ও সবার জেরার মুখে তিনি সত্য কথা বলতে বাধ্য হন। আর এভাবে তাঁরা প্রাণীটিকে উদ্ধার করেন। এরপর জুয়েলসহ পুঞ্জির সবাইকে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝিয়ে ও অঙ্গীকার আদায় করে প্রাণীটিকে নিয়ে শ্রীমঙ্গল ফিরে আসা হয়। দুই দিন বন বিভাগের জানকিছড়া রেসকিউ সেন্টারে প্রাণীটির শুশ্রূষা করে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হয়।
উদ্ধার করা অতি বিরল ও মহাবিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীটি চীনা বনরুই। ইংরেজিতে বলে চায়নিজ প্যাঙ্গুলিন। ফোলিডাটা বর্গের ম্যানিডি গোত্রের প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Manis pentadactyla। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এদের দেখা মেলে। চীনা ছাড়াও এ দেশে দেশি ও মালয় প্রজাতির বনরুই রয়েছে।
অন্যান্য প্রজাতির বনরুইয়ের মতো চীনা বনরুইও মাছের মতো আঁশে আবৃত বিচিত্র ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী। লেজ বাদে গড় দৈর্ঘ্য ৬০ সেন্টিমিটার ও লেজ ১৮ সেন্টিমিটার। দেহ ছিপছিপে ও গোলাকার। মাথা ছোট ও সরু।
এরা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনে বাস করে। অত্যন্ত লাজুক ও নিশাচর হওয়ায় সহজে নজরে আসে না। মাটিতে বাস করলেও গাছে চড়তে ওস্তাদ। অত্যন্ত অলস ও ধীর গতিসম্পন্ন প্রাণী। সারাটা দিন গর্তে ঘুমিয়ে কাটায় ও রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়। উইপোকা ও পিঁপড়া মূল খাদ্য। লেজটি কোনো গাছের ডালে জড়িয়ে দিব্যি ঝুলে থাকতে পারে। বিপদ দেখলে সামনের দুপায়ের ভেতর মাথাটা ঢুকিয়ে লেজ দিয়ে পুরো দেহ ঢেকে বলের মতো বানিয়ে শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করে।
মাংসের জন্য শিকারের কারণে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বনরুই বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ভণ্ড কবিরাজরা এদের আঁশ থেকে তথাকথিত ওষুধ তৈরির কারণে প্রাণীটি মহাবিপন্ন হয়ে পড়েছে। কাজেই এদের সংরক্ষণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।