মহাবিপন্ন লেকুয়া গর্জন

সিলেটের গোলাপগঞ্জ থেকে সম্প্রতি তোলা লেকুয়া গর্জন ফুল
ছবি: লেখক

আমাদের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ আবাসের মধ্যে বৃহত্তর সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্যতম। অধিকাংশ উদ্ভিদের প্রাপ্তিস্থান হিসেবে এ দুটি অঞ্চলকেই প্রমাণক সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ কারণে উদ্ভিদ গবেষকদের কাছে স্থান দুটি স্বপ্নতীর্থের মতোই। সুযোগ পেলে বিভিন্ন মৌসুমে হাজির হই সেখানে। ঘুরে বেড়াই অচেনা উদ্ভিদের সন্ধানে। তবে তুলনামূলকভাবে চট্টগ্রাম থেকে বৃহত্তর সিলেটেই গিয়েছি বেশি। কারণ, উদ্ভিদবৈচিত্র্যে এই অঞ্চল অন্যতম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

এটা শুধু আমার একার কথা নয়, ব্রিটিশ ভারতের অরণ্যতরু সন্ধানী জে ডি হুকারও খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের উদ্ভিদ জরিপ প্রসঙ্গে একই কথা বলেছেন। দ্য হিমালয়ান জার্নাল গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘খাসিয়া পাহাড়ের গাছগাছালির বিস্তারিত বিবরণ লেখার অবকাশ এখানে নেই, কেননা এগুলোর সংখ্যা ও বৈচিত্র্য এতই অধিক যে কেবল ভারত কেন, সম্ভবত গোটা এশিয়ায়ও এমন দ্বিতীয়টি আর নেই।’ তাঁর এই কথার প্রমাণ অনেকবারই হাতে হাতে পেয়েছি। কিছুদিন আগে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় নিউইয়র্কপ্রবাসী সাংবাদিক ইব্রাহিম চৌধুরীর বাড়ি লাগোয়া একটি গ্রামে গিয়ে আবারও উপলব্ধি করি, হুকার যথার্থই বলেছিলেন।

গোলাপগঞ্জের এদিকটায় অনুচ্চ টিলাগুলোর ওপর সুন্দর ছিমছাম বাড়ি। চারপাশ বুনো গাছগাছড়ায় ঠাসা। বসতিও খুব বেশি নেই। অভ্যাসবশত ঘুরে ঘুরে গাছগুলো দেখছি। হঠাৎ একটি লাল রঙের ফুলে চোখ আটকে গেল। এ তো পালাম ফুল! মনে পড়ল অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা ঢাকায় দুটো পালাম গাছ লাগিয়েছিলেন। যার একটি ঢাকায় রমনা পার্ক নার্সারি ও অন্যটি শিশু একাডেমির বাগানে দেখা যায়। পালামের পাশেই পাওয়া গেল ফলভর্তি লটকন (ভুবি) আর ডেফলগাছ।

পালাম ফুলের ছবি তুলে সরু পথ ধরে আরেকটি টিলা পাশ কাটাতেই চোখে পড়ল ব্যতিক্রমী একটি অচেনা ফুল। প্রথমে ভেবেছিলাম কোনো লতানো গাছের ফুল। ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখি এটি আসলে একটি বৃক্ষ। ডালপালার ভেতর ক্যামেরার লেন্স গলিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে রাখলাম।

ঢাকায় ফিরে ফুলটির সঠিক পরিচয় জানতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরদার নাসির উদ্দিনের শরণাপন্ন হলাম। তিনি জানালেন, এটি সুতাগোলা বা লেকুয়া গর্জন। স্থানীয়ভাবে লাইসা গর্জন নামেও পরিচিত। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, গাছটি মহাবিপন্ন! হাতে গোনা যায়Ñএমন কটি গাছই কেবল আছে আমাদের বনে। আশ্চর্য হই, লোকালয়ের এই অগভীর বনে এমন একটি মহাবিপন্ন বৃক্ষ বেঁচে আছে? জানি না, গাছটি আর কত দিন সেখানে সুরক্ষিত থাকবে!

চিরসবুজ লেকুয়া গর্জন সাধারণত ১২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। বাকল ফ্যাকাশে ধূসর ও মসৃণ। ডাল হালকা গড়নের, পাতার ডাঁটা প্রায় ২ সেন্টিমিটার লম্বা। পাতা উপবৃত্তাকার থেকে লেন্স আকৃতির, সাধারণত ১০ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা। সুগন্ধি ফুলগুলো ১২ সেন্টিমিটার দীর্ঘ, পাপড়ি দেখতে চাবুকের মতো, দেড় থেকে ২ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং ২ মিলিমিটার দীর্ঘ কুঁড়িতে উন্মুক্ত অংশগুলো মখমল-রোমশ। পুংকেশরের সংখ্যা ১৫, আয়তাকার। ফল গোলাকার, নাট-আকৃতির, দেড় থেকে আড়াই সেন্টিমিটার চওড়া, শীর্ষ দীর্ঘাগ্র ও মখমলসদৃশ।

এ গাছের কাঠ প্রধানত নির্মাণকাজ, তক্তা ও ঘরের খুঁটি তৈরিতে ব্যবহার্য। কাঠে সূক্ষ্ম বুনন থাকায় কাপড় বোনার মাকু, সুতা রাখার ববিন এবং গণিত শাস্ত্রের যন্ত্রাদি তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত। রেলপথের স্লিপার হিসেবেও এই কাঠ বেশি ব্যবহার করা হতো। তা ছাড়া এ গাছের বাকল ও কাঠ থেকে প্রাপ্ত রেজিন ধূপ হিসেবে ব্যবহার করে তামাকপাতার সুগন্ধি করা হয়। এই তামাকপাতা পানের সঙ্গে চিবানো হয়। ফুল ও ফলের মৌসুম মে থেকে আগস্ট। লেকুয়া গর্জনের (Vatica lanceaefolia) সারকাঠ হলুদাভ বাদামি রঙের ও বিশেষ ধরনের গন্ধযুক্ত। বীজের সাহায্যে বংশ বিস্তার হয়। রেকর্ড অনুযায়ী এই গাছ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরহরিৎ অরণ্যে জন্মে। কিন্তু ওই গাছ সিলেটেই প্রাকৃতিক আবাসে পাওয়া গেল।