মাখনার জন্য ২৫০ কিমি

মাখনা ফুলের ছবিটি ৭ এপ্রিল হাকালুকি হাওরের চাতলার বিল থেকে তোলা
ছবি: লেখক

প্রাকৃতিক আবাসে মাখনা ফুলের সন্ধান করছি অনেক দিন ধরে। বাইক্কা বিলসহ কয়েকটি জলাশয়ে গাছও দেখেছি। কিন্তু ফুল যেন স্বপ্নই থেকে গেল। নানা কারণে সব গাছে প্রতিবছর ফুল হয় না। আবার কোনো কোনো বছর ঢলের পানিতে মৌসুমের আগেই তলিয়ে যায় গাছগুলো। কিছুদিন আগে আশার কথা শোনালেন পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক। তিনি জানালেন, হাকালুকি হাওরের জুড়ী অংশেই মাখনা ফুলের সন্ধান পাওয়া যাবে। শীতের পরপরই ফুলের মৌসুমে অনুসন্ধান শুরু হলো।

সপ্তাহ তিনেক আগেই পরিবেশকর্মী মো. জাহাঙ্গীর আনন্দের খবরটি জানালেনহাকালুকি হাওরের চাতলার বিলে কয়েকটি ফুল দেখা গেছে। খবর পেয়েই রাতের গাড়িতে চেপে বসলাম। ২২০ কিলোমিটার পার হয়ে ভোরের আলো–আঁধারিতে বাস থেকে নামলাম। আরও ৩০ কিলোমিটার পথ বাকি। দিনের আলোয় যখন হাওরের উদ্দেশে রওনা হলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা সাতটা পেরিয়েছে।

পথে পথে বরুণ আর হুরহুরি ফুলের উৎসব মনোমুগ্ধকর। জুড়ী উপজেলার নয়াগ্রাম হয়ে চাতলার বিলে পৌঁছাতে আরও খানিকটা সময় লাগল। যেতে যেতে বারবার শিহরিত হই, বর্ষায় বিপুল জলে ডুবে থাকা হাওরের বুক চিরে আমরা দিব্যি অটোরিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি! দেখা হলো কয়েকটি নিঃসঙ্গ হিজলের সঙ্গে। কৃষকেরা ধান কেটে বাড়ি ফিরছেন। এসব দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম মাখনা ফুলের কাছে। এমন একটি মুহূর্তের জন্য কত দিন অপেক্ষা করেছি!

নির্জন এই প্রান্তরের সব সৌন্দর্য যেন ভিড় করেছে বেগুনি আভার মাখনা ফুলগুলো ঘিরে। কৌলীন্যের বিচারে হয়তো ওরা উচ্চবংশীয় নয়। কিন্তু আমার কাছে গুরুত্ব ভিন্ন কারণে। যার মধ্যে অন্যতম হলো দুষ্প্রাপ্যতা। নিকট অতীতে সহজলভ্য এ ফুল এত দ্রুত কেন দুর্লভ হয়ে উঠেছে, তার দুটো কারণ অন্তত বলা যায়। প্রধানত আবাসস্থল ধ্বংস ও দ্বিতীয়ত অতিরিক্ত মাত্রায় ফল আহরণ। এখনো পুরান ঢাকার কোথাও কোথাও মাখনার ফল বিক্রি হতে দেখা যায়, যা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত।

প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রিটিশ অরণ্যতরু সন্ধানী জোসেফ ড্যালটন হুকার এ অঞ্চলের উদ্ভিদ সমীক্ষার রোজনামচায় মাখনার কথা বলেছেন। যার বর্ণনা দ্বিজেন শর্মার লেখা হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ড্যালটন হুকার গ্রন্থে পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘....হুকার ও টমসন ঢাকার বাজারে আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা ও কমলার সঙ্গে মাখনার (Euryle ferox) বীজ বিক্রি হতেও দেখলেন। চীন দেশে তিন হাজার বছর আগেও মাখনার বীজ খাওয়ার চল ছিল।...’

শুধু বাংলাদেশ বা ভারতেই নয়, মাখনার ফল দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই বেশ জনপ্রিয়। এর প্রধান কারণ ফলটির পুষ্টিগুণ। শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, হৃদ্‌রোগ, বন্ধ্যাত্ব, প্লীহার সমস্যা, যকৃতের অসুখ, কাশি ও ডায়াবেটিসজনিত অসুস্থতার প্রতিকারে প্রাচ্যের চিকিৎসায় বহুদিন ধরেই মাখনা ব্যবহৃত হচ্ছে। অধিক পটাশিয়াম এবং কম সোডিয়াম থাকায় যাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, তাঁদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে ফলটি।

প্রতি ১০০ গ্রাম মাখনা ফলে শক্তির পরিমাণ ৩৫০ কিলোক্যালরি, যাতে স্নেহ পদার্থ-০.১ গ্রাম, প্রোটিন-৯.৭ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট-৭.৭ গ্রাম, ফাইবার বা আঁশের পরিমাণ-৭.৬ গ্রাম। এ ছাড়া মাখনার ফল ও বীজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি হয়। ফুচকা মচমচে ও মজাদার করার জন্য ফলের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাখনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

মিঠাপানির জলাধার, উন্মুক্ত জলাভূমি বা বিলে মাখনা জন্মে। মাখনা কাঁটাযুক্ত জলজ উদ্ভিদ যার শিকড় ও কন্দ পানির নিচে মাটিতে সন্নিবিষ্ট থাকে, পাতা প্রায় গোলাকার, পানির ওপরে ভেসে থাকে। আমাজন লিলির পর এর পাতা উদ্ভিদরাজ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফুল আকারে শাপলার চেয়ে ছোট।

ভেতরে উজ্জ্বল লাল রং, বাইরের দিকে সবুজ ও উজ্জ্বল বেগুনি রঙের। ফল গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির এবং বাইরের অংশ কাঁটাযুক্ত। ফল কচি এবং পরিপক্ব উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। ফলের ভেতরে ছোলার দানার মতো ছোট ছোট বীজ থাকে। সেগুলোর খোসা ছাড়িয়ে সাদা অংশটি খেতে হয়। এটি মিষ্টি স্বাদের। প্রতিটি ফলে সাধারণত ২০টি পর্যন্ত বীজ থাকে। ফুল ফোটে শীতের শেষে।