যেসব ফল প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্মে এবং উৎপাদনের জন্য সার ও ওষুধ প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না, তাকেই বুনো ফল বলা হয়। বাংলাদেশের প্রধান ফল ১০টি। আর বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় এমন ফলের সংখ্যা ১৮। এর বাইরে বুনো ফল ৬০ থেকে ৭০টি। তবে দেশের বিশিষ্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১৫০ প্রজাতির বুনো ফল খাওয়ার যোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন। তবে কিছু কিছু বুনো ফল মানুষের খাওয়ার পক্ষে উপযোগী নয়।
আমাদের প্রকৃতিতে সারা বছরই কয়েক প্রজাতির বুনো ফলের দেখা মেলে। তবে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকাল যেন বেশির ভাগ অপ্রচলিত ফল পরিপক্ব হওয়ার মৌসুম। এ সময় বনে-প্রান্তরে, ঝোপঝাড়ে নানা ধরনের পাকা ফল উঁকি মারে। বাজারেও ওঠে।
আমাদের অপ্রচলিত ফলের মধ্যে রয়েছে সফেদা, কামরাঙা, লটকন, বিলেতি আমড়া, বাতাবিলেবু, কতবেল, বেল, জলপাই, তাল, কালো জাম, করমচা, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, আদা জামির, কাঠলিচু, দেশি গাব, বিলেতি গাব, আতা, শরিফা, কাউফল, খেজুর, জামরুল, আমলকী, টক লেবু, চালতা, ডুমুর, বঁইচি, তেঁতুল, দেশি আমড়া, বকুল, বেতফল, ফলসা, জামরুল, বিলিম্বি, অরবরই, লুকলুকি, তৈকর, ডেউয়া, সাতকরা, পানিফল, কাগজিলেবু, মহুয়া, চাপালিশ ইত্যাদি। বর্ণে, ঘ্রাণে, স্বাদে ও আকৃতিতে এসব ফলের রয়েছে বিপুল বিভা ও বৈচিত্র্য।
আমাদের দেশে একেক বনাঞ্চলে একেক ধরনের অপ্রচলিত ফল দেখা যায়। চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার ও সিলেটের বনভূমিতে যেসব বুনো ফল জন্মে, ভাওয়াল, মধুপুরের মতো পত্রঝরা বনাঞ্চলে সে রকম জন্মে না, জন্মে অন্য প্রজাতির বুনো ফল। আমাদের সুন্দরবনেও আছে কেওড়া, গোলফলের মতো বুনো ফল। আর জলাশয়ে জন্মানো বুনো ফলের মধ্যে রয়েছে পানিকলা, মাখনা, শিঙাড়া, পদ্ম ও শাপলা। আর মানুষের বাড়িঘরের আঙিনা ও পতিত জমিতেও অনেক ধরনের অপ্রচলিত ফলের বাসস্থান।
রাজধানীর নিউমার্কেটের পূর্ব ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশের মুখে দেখা যাবে নানা ধরনের অপ্রচলিত ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বড় বাজারগুলোতেও তা মিলবে। আজকাল সুপারশপেও স্থান পেয়েছে বেতফল, অরবরই, কাঠলিচু, জাম, জামরুল, কতবেল, লটকন, গাবসহ নানা ধরনের অপ্রধান ফল। সম্প্রতি রাজধানীর খামারবাড়িতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্টলে নানা জাতের বুনো ফলের সমারোহ দেখা গেছে। তবে সরবরাহ কম বলে বাজারে এসব ফলের দাম বেশি।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কালো জামের কেজি ১৬০ থেকে ২০০ টাকা, জামরুল ৮০ থেকে ১০০, কাউফল ৭০ থেকে ৮০, কতবেল প্রতিটি ২০ থেকে ৪০ টাকা, লটকন প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা, গোলাপজাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, কাঠলিচু ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা।
কাউফলের জন্য পরিচিত বাগেরহাট জেলা। বর্ষাকালে একটু দমকা বাতাসে ঢবঢব করে গাছ থেকে পড়তে থাকে কাউফল। নরম কাদার মধ্যে আটকে গাছতলা হলুদ বর্ণ হতে দেখেছি। টক স্বাদযুক্ত এ ফল খেলে সাদা দাঁতে হলুদ রঙের প্রলেপ পড়ে। ফলে এ ফল সাধারণের কাছে আদর পায়নি। গ্রামবাংলায় কাউফল দিয়ে ডাল রান্না বেশ প্রচলিত ছিল।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী কিংবা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে বারবার এসেছে বঁইচি ফলের নাম। ছোটকালে পাকা বঁইচি ফল দিয়ে মালা বানিয়ে গলায় পরেছি। আর মালা থেকে ফল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছি। টক–মিষ্টি ও কষ স্বাদযুক্ত এ ফলকে আমরা বলতাম ডুঙ্কর বা ডুংখইর।
আপেল, কমলা, মাল্টা, নাশপাতি, বেদানার মতো বিদেশি ফলের ভিড়ে আমরা অনেকেই দেশি অপ্রচলিত ফলকে উপেক্ষা করি। কিন্তু এসব ফল আবহমানকাল ধরে আমাদের সংস্কৃতির অংশ। পুষ্টিমান ও ঔষধি গুণেও এসব ফল পিছিয়ে নেই। প্রায় সব অপ্রচলিত ফলেই কমবেশি খনিজ উপাদান বিদ্যমান। অপ্রচলিত ফলে থাকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় অংশ। এ জলীয় অংশ শরীরে পানির সমতা রক্ষা, খাদ্যদ্রব্য হজম, পরিপাক ও দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল রাখতে সহায়তা করে। একটি ছোট্ট আমলকীতে লুকিয়ে আছে পাঁচটি আপেলের সমান ভিটামিন সি। এ জন্যই বলা হয়, ‘ঋতুভিত্তিক দেশি ফলে, সকল রোগের আরোগ্য মেলে।’
পাশাপাশি এসব ফলের পরিবেশগত গুরুত্বও অনেক। কয়েক ধরনের বন্য প্রাণী ও পাখির প্রধান খাদ্য এসব বুনো ফল। এসব প্রাণী ফল খেয়ে বীজ বিস্তারে সহায়তা করে। আর এদের ফুলের মধু খেয়ে বেঁচে থাকে মৌমাছি আর কীটপতঙ্গ।
সাধারণত যে গাছের কাঠ আসবাব বানানোর পক্ষে উপযোগী, সে গাছ রক্ষা করা হয়। আমাদের এই একতরফা বৈষয়িক মনোবৃত্তির কারণে বুনো ফলের গাছের সংখ্যা প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগও এ ব্যাপারে উদাসীন। আর বুনো ফল ব্যবহারে লোকজ জ্ঞান কমে যাওয়াও এটা হারিয়ে যাওয়ার একটি কারণ।
অধ্যাপক জসীমউদ্দিন আলাপকালে বলছিলেন, ‘আমাদের প্রকৃতিতে বুনো ফলের প্রজাতির একটা তালিকা করা দরকার সবার আগে। এরপর যেসব প্রজাতির বংশবৃদ্ধি কম, তাদের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে, বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে। সরকারের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে রাখতে হবে বুনো ফলের গাছ। পার্কে, উদ্যানে করা যেতে পারে বুনো ফলের কর্নার। সবচেয়ে বেশি দরকার নতুন প্রজন্মের মধ্যে বুনো ফলের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার বীজ বপন করা।’ এ জন্য স্কুলের আঙিনায় বুনো ফলের গাছ রোপণের পরামর্শ দিলেন তিনি।
দেশি ফল, বেশি বল। তাই এই মৌসুমে আপনার ফল কেনার ফর্দে আম, কাঁঠাল, লিচুর পাশাপাশি থাকুক বেতফল, অরবরই, লুকলুকি, লটকন, গাবের মতো ‘অপ্রধান’ ফলও।