‘অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে
ভোরের দয়েলপাখি’
—জীবনানন্দ দাশ
তখন প্রতিটি বিকেল হতো শত শত সবুজ টিয়ার পুবের আকাশে ডানা মেলা দেখে, প্রতিটি সন্ধ্যা আসত শালিকের কিচিরমিচির কলরব শুনে। আর প্রতিটি সকাল হতো দোয়েলের মিষ্টি গানে। ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম বাড়ির আম ও কাঁঠালের ডালে বসে অবিরত ডেকে চলেছে একটি দোয়েল। মনে হতো ভোরের দোয়েলটি তার সবটুকু দরদ দিয়ে গান করছে। সাদা-কালো রঙের সেই পাখি মাঝেমধ্যে ডাকার সময় লেজ দোলাত। একদিন দুপুরে সেই কালো দোয়েলটির সঙ্গে দেখতে পাই আরেকটি দোয়েল। সেটি অনুজ্জ্বল কালচে এবং ছাই বর্ণের। গান গায় কদাচিৎ সংক্ষিপ্তভাবে, বেশির ভাগ সময় চুপ থাকে। ঘরের উত্তর দিকে পুকুরপাড়ের কাঁঠালের ডালে বসে থাকে তারা দুজন। ভাবলাম কেন তারা এখানে দিনের বেশির ভাগ সময় বসে থাকে। পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, কাঁঠালগাছের ঠিক পাশেই একটি সুপারিগাছ। একটি ফোকর আছে সামান্য ওপরে। দেখলাম, দোয়েল দুটি প্রায়ই সুপারিগাছের ফোকরে আসা-যাওয়া করছে। স্ত্রী দোয়েলটি বেশি। পুরুষটি দিনে দুবার থেকে তিনবার। নিশ্চিত হয়ে গেলাম দোয়েল জোড়া সুপারিগাছের ফোকরে বাসা বাঁধবে। ছেলেবেলার স্মৃতি। ছেলেবেলায় দিনের বেশির ভাগ সময় পাখির কার্যকলাপ দেখা ও পাখির বাসা খুঁজে বের করা ছিল আমার নেশা।
কয়েক দিন পর দেখলাম স্ত্রী দোয়েলটি খড়কুটো সংগ্রহ করছে এবং ফোকরে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিকে বড় ধরনের খড়কুটো, তারপর মাঝারি এবং শেষে মসৃণ ও নারিকেলের খোলের নরম আঁশ ও ঘাস—এই হলো তাদের বাসা বানানোর উপাদান। এক সপ্তাহ লাগল বাসা বানাতে। স্ত্রী পাখিটিই কেবল খড়কুটো সংগ্রহ করে বাসাটি তৈরি করেছে। পুরুষটি তাকে সঙ্গ দিয়েছিল যাওয়া-আসার পথে। এরপর কয়েক দিন তাদের বাসায় আসা-যাওয়া দেখিনি। কিছুদিন পর স্ত্রী দোয়েলটি বাসায় ফিরল এবং দেখলাম ডিম দিয়েছে। প্রথম ডিম পাড়ার দুই দিন পর দ্বিতীয় ডিম। একে একে চারটি ডিম দিয়েছিল সেবার। ডিম ফ্যাকাশে নীল, তাতে সবুজ ও বাদামি দাগযুক্ত। স্ত্রী দোয়েলটি এককভাবে প্রায় দুই সপ্তাহ ডিমে তা দেওয়ার পর ডিম ফোটে। ছানাগুলোকে খাওয়ানোর দায়িত্বটাও বেশি পালন করে স্ত্রী দোয়েলটি। ছেলেটি কদাচিৎ। পুরুষ দোয়েল কেবল বাসার আশপাশে বসে পাহারা দেয় এবং ‘এলাকা’ নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য প্রজাতির শালিক কিংবা অন্য কোনো দোয়েল যুগল যেন বাসা না দখল করতে পারে, সে জন্য তার সতর্ক পাহারা থাকে।
প্রধানত মার্চ থেকে জুলাই মাসে দোয়েল বংশবৃদ্ধি করে। তখনই মূলত পুরুষ দোয়েল দরদ দিয়ে গান গায়। স্ত্রী দোয়েল পুরুষের উপস্থিতিতে অল্প করে গান গাইতে পারে। খাবারের তালিকায় আছে পোকামাকড়, ফুলের মধু, ছোট মাছ ও ছোট চিংড়ি। সিঙ্গাপুরসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশে দোয়েলের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, ভাতশালিকের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে। কারণ, বাসা বানানোর জন্য দুটি প্রজাতিই প্রধানত ফোকরনির্ভর।
দোয়েল আমাদের জাতীয় পাখি। কবিতা, গানে ও মানুষের মনে দোয়েলের গান প্রভাব বিস্তার করে। তা ছাড়া দোয়েলের চোখ বড়ই মায়াবী। দোয়েলের মায়াভরা চোখ এবং আকুল করা গান আমাদের ইঙ্গিত দেয় জীবন দোয়েলের মতোই।